সুদীপ জোয়ারদার
‘ত্রিস্রোতা নদী বর্ষাকালের জলপ্লাবনে কূলে কূলে পরিপূর্ণ। চন্দ্রের কিরণ সেই তীব্রগতি নদীজলের স্রোতের উপর-স্রোতে, আবর্তে, কদাচিৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গে জ্বলিতেছে।’…
তিস্তার এমন কাব্যিক বর্ণনা যে উপন্যাসে রয়েছে তার নাম, ‘দেবী চৌধুরাণী’। উত্তরবঙ্গের পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাসে শুধু তিস্তা নয়, ছড়িয়ে রয়েছে রংপুর, দিনাজপুর এবং জলপাইগুড়ি জেলার জনপদ, জঙ্গল,পথঘাট।
উপন্যাসের শুরু বরেন্দ্রভূমিতে। এখানকার ভূতনাথ গ্রামে ছিল প্রফুল্লমুখীর শ্বশুরবাড়ি। আর সেখান থেকে ছ’ক্রোশ দূরে দুর্গাপুরে ছিল তার বাপের বাড়ি। প্রফুল্ল বৃদ্ধ বৈষ্ণব কৃষ্ণগোবিন্দের কুড়ি ঘড়া ধন পেয়ে যেখানে ঘরবাড়ি, সম্পত্তি করেছিল তার নাম দেবীগড়। এই দেবীগড় সম্ভবত দক্ষিণ দিনাজপুরের কাছের দেবীকোট বা বাণগড়।
প্রফুল্লকে পালকিতে যে রাস্তা বরাবর গোমস্তা দুর্লভ চক্রবর্তীর পালকি বাহকেরা নিয়ে যাচ্ছিল, তা দিনাজপুরের রাস্তা। উপন্যাসে এর উল্লেখও রয়েছে। তবে সরাসরি নয়, কিছুটা পরোক্ষ ভাবেই। আর যে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলে দেবী চৌধুরাণীর দরবার বসতো, সে তো জলপাইগুড়িরই বন!
‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসটি ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হলেও উপন্যাস রচনার সূচনা হয় ১৮৮২ সালে। বঙ্কিমচন্দ্র তখন জাজপুর, কটকের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তবে এই উপন্যাসের সলতে পাকানোর শুরু কিন্তু অনেক আগে। ১৮৭১-৭৪ সাল পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্র উত্তরবঙ্গের রাজশাহী কমিশনারের অধীনে কাজ করেছিলেন। পরে তিনি কিছুদিন মালদহ জেলায় রোড-সেসের দায়িত্বেও ছিলেন।
সেই সময়ে যেমন তিনি উত্তরবঙ্গের বন-জঙ্গল চাক্ষুষ করার সুযোগ পান, তেমনই হয়তো সরকারি কাগজপত্র ও হান্টারের Statistical Accounts of Bengal -এ ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণীর ঐতিহাসিক বিবরণ দেখেছিলেন। ইজারাদার দেবীসিংহের অত্যাচার ও তার বিরুদ্ধে প্রজা-বিদ্রোহ অষ্টাদশ শতকের ছয় ও সাতের দশকে উত্তরবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এডমন্ড বার্কের বক্তৃতায় এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। দেবীসিংহ সম্পর্কে তথ্য বঙ্কিমচন্দ্র পেয়ে যান সেখানেই। এ সবের পটভূমিকায় দেবী চৌধুরানীকে নিয়ে একটি কল্পনা-নির্ভর সামাজিক উপন্যাস লেখার কথা হয়তো তখনই বঙ্কিমের মাথায় আসে।
ইতিহাসের যে দেবী চৌধুরাণী এই উপন্যাসের প্রেরণা, কল্পনার আশ্রয়, তিনি অনেকের মতে রংপুর কাউনিয়ার জমিদার ব্রজকিশোর রায়চৌধুরীর কন্যা জয়দুর্গা রায়চৌধুরী। কিশোরীকালেই জয়দুর্গার বিয়ে হয়েছিল মন্থনা বা পীরগাছার জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর সঙ্গে। পরে স্বামীর অকালমৃত্যুর কারণে জমিদারির ভার চলে আসে জয়দুর্গার উপরে। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন, সংস্পর্শে আসেন ভবানী পাঠকের সঙ্গে। হয়ে ওঠেন, ইংরেজের ভাষায় ‘ডাকাইত’।
১৮৬৯ সালে নতুন জলপাইগুড়ি জেলার পত্তন হয়। তার আগে রংপুর জেলার মধ্যে জলপাইগুড়ি জেলার অনেকটা অংশই থেকে গিয়েছিল। ফলে, করলা আর তিস্তা অববাহিকা জুড়ে বিরাট এক এলাকায় ছিল দেবী চৌধুরাণীর যাতায়াত। আজও জলপাইগুড়ি জেলায় দেবী চৌধুরাণীর সঙ্গে জড়িত তিনটি মন্দিরের অস্তিত্ব অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে। ইতিহাসের দেবী চৌধুরাণীকে ঘিরে গড়ে ওঠা ‘মিথ’ বঙ্কিমচন্দ্রকে রোমাঞ্চিত করেছিল। সেই একই রোমাঞ্চ বাঙালি পাঠক ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাস থেকেও পায়।
বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাস-আশ্রয়ী অন্য উপন্যাসে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শোনা যায় পাতায় পাতায়। এই উপন্যাসে ঘোড়া নেই। ঘোড়ার পরিবর্তে রয়েছে বজরা-ছিপ-পানসি এবং তাদের প্রায়-নিঃশব্দ চলাচল। যেখান থেকে উপন্যাসের কাহিনি ঐতিহাসিক নানা ঘটনা ও চরিত্রে আশ্রয় নিয়েছে, সেখান থেকেই তিস্তার উপর শুরু হয়েছে বজরা-ছিপ-পানসির এই চলাচল। নদী থেকেও পাঠক অন্য অভিজ্ঞতা লাভ করে। তিস্তা এই উপন্যাসে একই সঙ্গে পথ ও রণক্ষেত্র। উত্তরবঙ্গের তিস্তা এই উপন্যাসেরও যেন প্রাণ-ভোমরা। প্রমথনাথ বিশীর ভাষায় বাস্তবিকই ‘কাহিনীর কায়া’।