শুধুই রিঙ্গার্স ল্যাকটেট (আরএল)? নাকি সিজ়ারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত অন্য কোনও ইন্ট্রাভেনাস (আইভি) ওষুধেও সমস্যা আছে? না হলে আরএল নিয়ে বিপর্যয় শুধু প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগেই ঘটছে কেন, সেই প্রশ্ন এখন ভাবাচ্ছে চিকিৎসকদের। তার মধ্যে রয়েছেন স্বাস্থ্য দপ্তর গঠিত ১৩ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটির একাধিক চিকিৎসকও। সম্প্রতি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে এক প্রসূতির মৃত্যু ও চার প্রসূতির গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাই নয়, এর আগে কখনও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল, কখনও ইসলামপুর মহকুমা হাসপাতাল, কখনও বা বারুইপুর মহকুমা হাসপাতাল কিংবা আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতাল— মাঝেমধ্যেই শুধু প্রসূতি বিভাগে এমন অঘটনের নজির সামনে এসেছে।
এই বিপর্যয়ে আসল ভিলেন শুধুমাত্র আরএল কি না, সেই সংশয় তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে। কারণ, এই আইভি ফ্লুইড বিভিন্ন সার্জারি ও মেডিসিন বিভাগে কমবেশি ব্যবহার হয়েই থাকে বছরভর। সেখানে এমন সমস্যার খবর চট করে মেলে না।
অথচ প্রসূতি বিভাগে মাঝেমধ্যে এমন গন্ডগোল ঘটছে, যার জেরে প্রাণহানি অথবা প্রাণসংশয় ঘটলেও তার যুৎসই ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা। সে জন্যই সন্দেহ দানা বাঁধছে প্রসবের সময়ে, বিশেষত সিজ়ারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত অন্য তিন-চারটি ওষুধের মান নিয়ে। তাই আরএলের সঙ্গে অক্সিটোসিন, ভ্যাসোপ্র্যাসিন, মিথাইল আর্গোনোভিন, মেটোক্লোপ্রামাইড ইত্যাদির গুণমানের দিকে নজর রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, প্রসববেদনা ত্বরাণ্বিত করা ও প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে প্রায় সব প্রসূতিকেই অক্সিটোসিন আইভি দেওয়া হয়। কখনও বা তা আইভি ইঞ্জেকশন হিসেবে, আবার কখনও তা আরএল ফ্লুইডের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। একই কারণে দেওয়া হয় ভ্যাসোপ্র্যাসিন। জরায়ুকে সংকোচন করার জন্য দেওয়া হয় মিথাইল আর্গোনোভিন।
আর সিজ়ারের ক্ষেত্রে বমি এবং পাকস্থলি থেকে খাবার ও অ্যাসিডের উপরে উঠে আসা ঠেকাতে ব্যবহার করা হয় মেটোক্লোপ্রামাইড। বিশেষজ্ঞ কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, ‘এই ওষুধগুলি, বিশেষ করে অক্সিটোসিন একযোগে আরএলের সঙ্গে অন্য কোনও বিভাগের রোগীকে দেওয়া হয় না বলেই কি প্রসূতি বিভাগেই ঘটছে অঘটন? এই আশঙ্কা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই এই সব ওষুধগুলির নমুনাও গুণমান পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।’
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের গলাতেও এক সুর। ফেডারেশন অফ অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গায়নেকোলজিক্যাল সোসাইটিজ় অফ ইন্ডিয়া (ফগসি)-র রাজ্য শাখার সভাপতি বাসব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আরএলের সঙ্গে অন্যান্য ওষুধ, বিশেষ করে অক্সিটোসিনের মিলিত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু আরএল অপরিস্রুত থাকলে একরকম। কিন্তু তার সঙ্গে যদি দূষিত অক্সিটোসিন মেশে, তা হলে ক্ষতিটা কয়েক গুণ বেড়ে যেতে বাধ্য।’
প্রবীণ প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘সরকার-প্রশাসন সব সময়ে ডাক্তারদের দোষ খুঁজতেই ব্যস্ত। যথাযথ বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এই অঘটনের কারণ খোঁজার চেষ্টা হলেই ধরা পড়ে যেত আসল সমস্যাটা। ওষুধের গুণমান কখনওই আমাদের এখানে ঠিকঠাক ভাবে যাচাই হয় না।’
স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকদের একটা বড় অংশই মনে করছেন, স্টেট ড্রাগ কন্ট্রোলের অধীন ল্যাবের যা পরিকাঠামো, তাতে ওষুধের মান পরখ করার ব্যাপারটাই এ রাজ্যে অলীক স্বপ্ন! কারণ, সেই ল্যাবে ৪০ জন টেকনোলজিস্টের বদলে কাজ করেন মাত্র ১২ জন।
ফলে গড়ে শ’তিনেক নমুনা পরীক্ষার কথা থাকলেও সেই ল্যাব প্রতি মাসে বড়জোর ৮০-৯০টি নমুনার বেশি পরীক্ষা করে উঠতে পারে না। ফলে জমতে থাকে ব্যাকলগের পাহাড়। আর যত দিনে কোনও নমুনার রিপোর্ট আসে, তত দিনে হয়তো সেই ওষুধ ব্যবহারই হয়ে গিয়েছে রোগীর উপর। সেই ওষুধের মান খারাপ হলে তার মাশুলও অজান্তেই দিয়ে দেন রোগী। মেদিনীপুরের ঘটনাতেও তেমনটাই হয়েছে কি না, সত্যিই জানে না কেউ!