স্টাফ রিপোর্টার: আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের মামলায় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে আদালত দোষী সাব্যস্ত করা ইস্তক দাবি এখন একটাই, সঞ্জয়ের ফাঁসি চাই। গলি থেকে রাজপথের জটলায়, আড্ডায়। আদালতের ভিতর ও বাইরের আইনজীবী মহলে। শহরের বিদগ্ধ মহলের বৃহত্তর অংশ থেকে শুরু করে শহরতলির জনমহলের সর্বস্তরে। এমনকী, চূড়ান্ত সাজা ঘোষণার আগেও কতিপয় ‘ডাক্তারবাবু’দের বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা উড়িয়ে চিকিৎসক মহলেরও আনাচে-কানাচে। সোমবার ‘দোষী’ সঞ্জয় রায়ের সাজা ঘোষণা করবেন শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস। আইনি বিধানে সঞ্জয়ের সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে মৃত্যুদণ্ড, সর্বনিম্ন যাবজ্জীবন।
কিন্তু বিচারকের সাজা ঘোষণার আগে রবিবার সংশ্লিষ্ট সব মহলই একসুর, পৈশাচিকতা ও চরম অমানবিকতায় সঞ্জয় রাই যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে আদালতে প্রমাণিত, সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি ছাড়া আর কোনও শাস্তিই তার যথোপযুক্ত নয়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই থেকে শুরু করে নির্যাতিতার বাবা-মা ইতিমধ্যেই সঞ্জয়কে সর্বোচ্চ সাজা দিতে আদালতে আবেদন জানিয়েছেন। শনিবার শিয়ালদহ আদালতের এডিজে (১) অনির্বাণ দাসের এজলাসে বহু প্রতীক্ষিত আর জি কর মামলার রায়দান হয়। তুলে বিচারক জানিয়ে দেন, তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ ধারায় ধর্ষণ, ৬৬ ধারায় ধর্ষণের সময় আঘাতের কারণে মৃত্যু, ১০৩ (১) ধারায় খুনের দায়ে একমাত্র সঞ্জয় রায়কেই দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। যেহেতু মাঝখানে রবিবার ছুটির দিন, তাই সোমবার সঞ্জয় রাইয়ের সাজা ঘোষণা করবেন বলে জানিয়ে দেন বিচারক।
আদালত সূত্রের খবর, ধর্ষণের দায়ে ‘দোষী’ সঞ্জয় রায়ের দশ বছরের কারাদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। ধর্ষণের সময় আঘাতের কারণে মৃত্যুর দায়ে সঞ্জয়ের ২৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। খুনের দায়ে ‘দোষী’ সঞ্জয় রাইয়ের শাস্তি সর্বনিম্ন যাবজ্জীবন ও এর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। আইনজীবীদের মতে, এই গুরুতর অপরাধে কোনও অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করার পর তার মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দুই-ই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিচারপর্বের শেষে সিবিআইয়ের আইনজীবীরা নিজেদের সওয়ালের সময় আদালতের কাছে অভিযুক্তের সর্বোচ্চ সাজার আবেদন জানিয়েছেন। আবার নির্যাতিতার আইনজীবীরাও তাঁদের সওয়ালে বলেন, তাঁরাও সঞ্জয় রাইয়ের সর্বোচ্চ সাজা তথা ফাঁসি চান। বিচারকের চূড়ান্ত সাজা ঘোষণার দিকেই আপাতত তাকিয়ে সবাই। আজ, সোমবার দুপুর সাড়ে বারোটায় ‘দোষী’ সঞ্জয় রায়কে আদালতে তোলা হবে। বিচারক সঞ্জয়ের বক্তব্য শুনতে পারেন।
সেক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও সঞ্জয় এদিনও আদালতের কাছে নিজেকে ‘নির্দোষ’ দাবি করতে পারে। বিচারক এদিন শুনতে পারেন সঞ্জয়ের আইনজীবীর বক্তব্যও। এই পর্যায় শেষ হওয়ার পর এদিন দুপুর দুটো বা আড়াইটে নাগাদ সঞ্জয় রায়ের সাজা ঘোষণা করতে পারেন বিচারক। এদিকে, পুলিশ সূত্রের খবর, সোমবার সাজা ঘোষণার দিন শিয়ালদহ আদালতে থাকছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা। এদিনও আদালতের বাইরে বিক্ষোভ দেখানো হতে পারে। তাই আদালত চত্বর সকাল থেকেই ঘিরে রাখছে পুলিশ। আদালতের প্রত্যেকটি গেটে থাকছে অতিরিক্ত পুলিশি নিরাপত্তা। কোনও অযাচিত ব্যক্তি আদালত চত্বরে প্রবেশ করছে কি না, সেদিকে নজর থাকছে পুলিশের। এদিন খোলা আদালতেই সাজা ঘোষণা হতে পারে। কিন্তু অযাচিত কোনও ব্যক্তি যাতে আদালত কক্ষে প্রবেশ করতে না পারে, সেদিকেও বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গত ৯ আগস্ট আর জি কর হাসপাতালের চারতলায় সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার হয়েছিল মহিলা চিকিৎসকের দেহ। সেদিনই উত্তর কলকাতার টালা থানায় তাঁকে ধর্ষণ ও খুনের মামলা দায়ের হয়েছিল। এর এক দিনের মাথায় কলকাতা পুলিশের হাতেই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসাবে গ্রেপ্তার হয় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। কলকাতা পুলিশ সাকুল্যে মাত্র পাঁচদিন তদন্তের সুযোগ পেয়েছিল। সেই তদন্ত চলাকালীনই হাই কোর্টের নির্দেশে সিবিআই এর তদন্তভার নেয়। তিন মাসের মধ্যে চার্জশিট পেশ করে কলকাতা পুলিশের দাবিতেই কার্যত সিলমোহর দিয়ে সিবিআইও জানিয়ে দেয়, আর জি করে তরুণী চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনে সঞ্জয় রায়ই একমাত্র অভিযুক্ত।
ইতিমধ্যে আর জি করের প্রাত্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে তথ্য ও প্রমাণ লোপাট, ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে সিবিআই তিন মাসের মধ্যে চার্জশিট পেশ করতে পারেনি। তাই তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। এদিকে, কলকাতা পুলিশের হাতেই ধৃত সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের দায়ের করা চার্জশিটের ভিত্তিতে এরপর এই মামলায় বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়। তারই ভিত্তিতে শুরু হয় সঞ্জয় রাইয়ের বিচারপর্ব। দু’মাসের বিচারপর্বের শেষে শনিবার সঞ্জয়কে আদালত দোষী সাব্যস্ত করে। এদিন ১৬০ পাতার ‘অর্ডার’ দিয়ে সঞ্জয় রাইকে দোষী সাব্যস্ত করেন বিচারক।