অর্ঘ্য বিশ্বাস, জলপাইগুড়ি
এ যেন আকাশের দিকে চেয়ে বলে দিতে পারা, ‘এ মেঘে বৃষ্টি নামবে।’ সে কথা নির্ভুল ভাবে মিলেও যায়। এই গল্পটাও তেমনই একজনকে নিয়ে। তবে মেঘ দেখে নয়, তিনি জঙ্গলের গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারেন, ‘এই পথেই হাতি আসবে।’ কিছুক্ষণ পরেই তাঁর সহকর্মীরা অবাক হয়ে দেখতেন, ঠিক তাই। হাতিই আসছে।
লাটাগুড়ি জঙ্গলে তাঁর দেখানো পথেই এক সময়ে হাতি ও অন্য বন্যপ্রাণের খোঁজ পেতেন সহকর্মীরা। বয়সের ভারে আজ তিনি ক্লান্ত। দৃষ্টিশক্তিও কমে এসেছে। চাকরি জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে এখন সেই সব স্মৃতি মনে পড়ে তাঁর। আগের মতো আর জঙ্গলে ছুটতে পারেন না। তবে নিয়ম করে সকাল–বিকেল বিট অফিস চত্বরের গাছগুলোতে জল দিতে ভোলেন না। তিনি জলপাইগুড়ি বনবিভাগের লাটাগুড়ি রেঞ্জের বড়দিঘি বিটের বনকর্মী ডম্বর ছেত্রী। গাছে জল দিতে দিতে তিনি বলছেন, ‘আমি চলে গেলে গাছগুলো যে কে দেখবে, কে জানে!’
বছর কয়েক আগের কথা। লাঠি হাতে সহকর্মীদের সঙ্গে লাটাগুড়ি জঙ্গলের আনাচ-কানাচে ঘুরে বেড়াতেন ডম্বর। ডাল ভাঙার শব্দ কানে এলেই বাকিদের সজাগ করে দিতেন, ‘এই পথেই হাতি আসবে এখনই!’ কখনও আবার দূর থেকেই ‘পিছে’ (পিছনে) কিংবা ‘মাইল’ (সামনে) বলে চিৎকার করতেন। যা শুনে হাতিও যেন পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে পা বাড়াত।
লাটাগুড়ি জঙ্গলের শাল, সেগুন, জারুল, খয়ের, মহুয়ার বন ছিল তাঁর একেবারে নখদর্পণে। কোথায় গেলে হাতির দেখা মিলবে, কত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইসনের পাল, কোথায় গেলে দেখা যাবে গন্ডার, সবই তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। দূর থেকে ভেসে আসা গন্ধ শুঁকে আন্দাজ করতে পারেন, জঙ্গলের ঠিক কোন প্রান্তে হাতি রয়েছে।
রাতেও অত্যন্ত সজাগ থাকত তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। কাঠ পাচারকারীর হাত থেকেও একাধিকবার জঙ্গলকে রক্ষা করেছেন ডম্বর। নিয়ম করে টহল দিতেন জঙ্গলে। বিপদের সঙ্কেত পেলেও তাঁকে কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি। বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। বড়দিঘি বিট যাওয়ার রাস্তায় প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকত বিশাল এক দাঁতাল। ভয়ে অনেকেই সে পথে পা বাড়াতেন না। কিন্তু ডম্বর কাজে অনড়। বেশ কয়েকবার হাতির মুখোমুখি হয়েও বরাত জোরে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন।
চাকরি জীবনের শেষে এসে অতীতের কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ ছলছল করে। কাঁপা গলায় বলেন, ‘আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরেই চিরকালের মতো জঙ্গল ছেড়ে বাড়ি ফিরে যেতে হবে৷ নিজের বাড়ির মতো আগলে রেখেছিলাম এই বড়দিঘি বিট৷’ চাকরির প্রথম জীবনে জলপাইগুড়ি বন বিভাগের দলগাওঁ রেঞ্জে বেশ কয়েক বছর কাজ করার পরে চলে আসেন লাটাগুড়ি রেঞ্জের বড়দিঘি বিটে। মূর্তি নদীঘেঁষা নিউ খুনিয়া বস্তিতে ডম্বরের বাড়ি। জীবনের বাকি সময়টুকু স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ের সঙ্গেই কাটাবেন বলে জানালেন তিনি।
জলপাইগুড়ির প্রাক্তন বনাধিকারিক বাদল দেবনাথের কথায়, ‘বনকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে করতে জঙ্গল ও বন্যপ্রাণের সঙ্গে মিশে যান। বুনোদের গতিবিধি, ডাক, শব্দ, চলাফেরার রাস্তা কিংবা গন্ধ শুঁকে তাদের উপস্থিতি বলে দিতে পারেন। ডম্বরও জীবনভর এই কাজটাই করেছেন।’