সব্যসাচী ঘোষ, মালবাজার
যে সিঁড়ি দিয়ে মাস্টারমশাইরা নেমে আসতেন, কেউ সেই সিঁড়িতে হাত রেখে চোখের জল ফেললেন। কেউ আবার স্কুলের নতুন ভবনে তাঁদের সময়ের হেড মাস্টারের নাম দেখতে পেয়ে সেখানেই প্রণাম করে বসলেন। কেউ মাঠের ঘাস ছুঁয়ে মাথায় ঠেকালেন। ৪৯ বছর পর আবার সেই পুরোনো স্কুলে প্রবেশ করে এমন ভাবেই আবেগ তাড়িত হলেন স্কুলের তিন প্রাক্তনী।
বিমলপ্রসাদ ভট্টাচার্য, তাপস মুখোপাধ্যায় এবং প্রদীপকুমার চক্রবর্তী তিন বন্ধু উত্তরের তিন শহরে থাকেন। বিমলপ্রসাদের বাড়ি কোচবিহারে। তাপস থাকেন শিলিগুড়িতে। ফালাকাটায় বাড়ি প্রদীপের। প্রায় ৬৫ ছুঁইছুঁই তিন বন্ধুর মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। কিন্তু, ছোটবেলার স্কুলে আর ফেরা হয়নি তাঁদের। এখন প্রত্যেকেই অবসরপ্রাপ্ত। অগাধ সময়। সে কারণেই পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনে ছেলেবেলার স্কুলকে ফিরে দেখার উদ্যোগ নিলেন তাঁরা। সবাই একত্রিত হলেন মালবাজার শহরে। আদর্শ বিদ্যাভবন স্কুলে রবিবার গেট খুলে ঢুকেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন তিন জনই।
সে প্রায় পাঁচ দশক আগের কথা। তিন বন্ধু পড়তেন বিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৭৬ সালে তাঁদের ব্যাচ ছিল উচ্চমাধ্যমিকের শেষ ব্যাচ, যাঁদের একাদশ শ্রেণিতেই উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক তারাকান্ত স্যর, লক্ষ্মণ স্যরের কথা বেশ মনে আছে তিন জনেরই। সবাই একসুরে স্বীকার করেন, এ রকম শিক্ষক তাঁদের পড়িয়েছেন বলেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সেনাবাহিনীর বড়কর্তা ছিলেন কেউ। কেউ পেশায় রেলের বাস্তুকার। আর একজন ওষুধ কোম্পানির আধিকারিক। কর্মজগত শেষ হয়েছে সকলেরই। তাই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে পুরোনো স্কুলকে হৃদয় থেকে কৃতজ্ঞতা জানাতেই এই সফর।
তাপস বলেন, ‘ভুটান লাগোয়া হিলা চা বাগান থেকে প্রতিদিন আসা সম্ভব ছিল না। সেই সময়ে স্কুলে ছাত্রাবাস ছিল। তক্ষশীলা নামের সেই ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশোনা করতাম।’ বিমল শোনালেন অন্য এক গল্প। বলেন, ‘আমার নামে প্রসাদ শব্দটা ছিল না। শব্দটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন স্কুলেরই মাস্টারমশাই। তার পর থেকে নাম বিমলপ্রসাদ।’ টুকরোটাকরা নানা স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন ওঁরা, স্কুলের আনাচেকানাচে।
২৩ জানুয়ারি আদর্শ বিদ্যাভবনের জন্মদিন। ৭৭ বছরের পুরোনো স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী দেশ এবং পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছেন। স্কুলের টানে অনেকেই আসতে চান। অনেকেই স্কুলের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু, এই তিন বন্ধু সেই বিকল্পে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই সশরীরে তিন জন হাজির হলেন মালবাজারে। তিন বন্ধুর দৃশ্য চোখে জল আনছে অন্যদেরও। ছোটবেলায় বিমলদের দেখেছেন মালবাজারের বাসিন্দা রাজেন প্রধান। গানে–গল্পে মাতিয়ে রাখতেন বিমল, সেই উজ্জ্বল স্মৃতি উদ্ধার করে আনলেন তিনি। বলেন, ‘সেই সময়ের শিক্ষকদের আর প্রায় কেউ পৃথিবীতে নেই। শুধু পঙ্কজ স্যরই রয়েছেন।’
বয়সের ভারে সব পুরোনো কথা মনে পড়ে না কারও। সবই রূপকথার মতো অলীক লাগে। হারিয়ে গিয়েছে পুরোনো গাছগুলিও। শুধু রয়ে গিয়েছে স্কুলের ছাদের নীচে শীতল ছায়া। তাতে প্রাণ জুড়িয়ে তিন প্রবীণের এই সফর কি শেষ হলো? না। হারানো সহপাঠী যাঁরা এখনও মালবাজারে আছেন, তাঁদের খুঁজতে বেরিয়ে পড়লেন বিমল–তাপস–প্রদীপ।