অর্ঘ্য বিশ্বাস, গোরুমারা
সন্ধে নামলেই নীলচে অন্ধকারে ডুবে যেত বনভূমি। তার মধ্যে থেকে উঠে আসত দ্রিম দ্রিম রব। দুলে উঠত কোমর। সীতা, বাসন্তীদের সঙ্গে পা মেলাতেন পর্যটকরা। এই দৃশ্য এখন স্মৃতি আর ক্যামেরার ফ্রেমে রয়ে গিয়েছে।
সত্যিই শেষ কবে পর্যটকদের সামনে ধামসার তালে তাঁরা নেচেছিলেন, তা একপ্রকার ভুলতে বসেছেন সীতা ওঁরাও, বাসন্তী ওঁরাও, মনিকা ওঁরাওরা। চার বছর আগের ভয়াবহ ঝড়ের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে গিয়েছিল গোরুমারা জঙ্গল ঘেঁষা ময়নাগুড়ি ব্লকের রামশাইয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বুধুরাম বনবস্তি। এখানেই ওঁদের বাস।
সেই আগুনে প্রচুর ঘর–বাড়ির সঙ্গে নষ্ট হয়ে যায় ধামসা, মাদল সমেত একাধিক শিল্প সামগ্রী। চার বছর পেরিয়ে গেলেও বদলায়নি এলাকার ছবি। ধুত্রু ওঁরাও, দিনু ওঁরাওদের মতো প্রবীণ শিল্পীদের হাতে ফের কবে বাদ্যযন্ত্র উঠবে, তা আজও প্রশ্নের মুখে। সীতার গলায় আক্ষেপ, ‘দীর্ঘ চার বছরে আমার মতো অনেকেই নাচ–গানের পেশা থেকে দূরে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। বাজানোর সরঞ্জামই তো নেই। ফের আদিবাসী নাচ চালু হলে এলাকায় কিছুটা হলেও আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরবে।’
ঝড়ের পর প্রশাসনের পাশাপাশি বুধুরাম বনবস্তির পাশে দাঁড়ায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। সেখানকার মানুষজন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরলেও আদিবাসী নাচের ছন্দ এখনও থমকে রয়েছে। স্থানীয় মহলে অভিযোগ, এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়নি বন দপ্তরও। এই অঞ্চলের অন্যতম পেশা ছিল এই আদিবাসী নাচ। শিল্পীরা মাসে গড়ে আয় করতেন হাজার টাকার মতো। মেদলা নজরমিনারে বেড়াতে গেলে সন্ধের মূল আকর্ষণ হিসেবে থাকত তিন বনবস্তির শিল্পীদের নৃত্য। কালীপুর, চাটুয়া ও বুধুরাম বনবস্তির শিল্পীরা এই নাচে–গানে মাতিয়ে রাখতেন পর্যটকদের। প্রবেশ মূল্য থেকেও কিছুটা অংশ পেতেন শিল্পীরা।
স্থানীয় একটি সূত্র জনিয়েছে, বেকারত্ব গ্রাস করায় অনেকে জড়িয়ে পড়েছেন নানা অপরাধমূলক কাজে। ময়নাগুড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কুমুদরঞ্জন রায় বলেন, ‘বন দপ্তরের কাছে আবেদন জানাব, যাতে পুনরায় এলাকায় আদিবাসী নাচ চালু করা হয়।’ গোরুমারার ডিএফও দ্বিজপ্রতিম সেনের কথায়, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।’
এলাকার ১৫ জনেরও বেশি মহিলা এই আদিবাসী নাচের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। সংসারের কাজ সেরে সন্ধ্যাকালীন এই নৃত্য পরিবেশন করে কিছুটা স্বনির্ভর হয়ে উঠছিলেন তাঁরা। গোরুমারায় বেড়াতে এসে পর্যটকেরা এখন শুধু কালীপুর ও চাটুয়া বনবস্তির শিল্পীদের নাচ দেখতে পান। টিকিটের দাম থেকেও একটি অংশ পান শিল্পীরা। চার বছর ধরে বুধুরামের শিল্পীরা তা থেকেও বঞ্চিত৷ স্থানীয় যৌথ বন পরিচালন কমিটির তরফেও বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বন দপ্তরের কাছেও দাবি জানানো হয়েছে। রামশাই গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান বিশ্বজিৎ ওঁরাও বলেন, ‘এলাকায় পর্যটনের শুরু থেকেই বুধুরাম বনবস্তির শিল্পীরা নাচ–গানের সঙ্গে থেকেছেন। তাঁদের বিষয়টি বন দপ্তরের কাছে তুলে ধরা হবে।’