রাজেন্দ্রনাথ বাগ
আরজি করে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছেন শিয়ালদহ কোর্টের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক অনির্বাণ দাস। সঞ্জয়কে এক লক্ষ টাকা জরিমানাও করেছে কোর্ট। পাশাপাশি নাগরিককে রক্ষায় ব্যর্থ সরকারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৭ লক্ষ টাকা (প্রাণহানিতে ১০ লক্ষ এবং ধর্ষণের শিকার বলে সাত লক্ষ) ওই চিকিৎসকের পরিজনের হাতে তুলে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
যদিও নিহত তরুণীর বাবা-মা ক্ষতিপূরণ চান না বলে জানিয়েছেন। এর আগে মুখ্যমন্ত্রীও পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিলেন। তখনও অবশ্য পরিবার তা নিতে অস্বীকার করেছিল।
সাধারণ ভাবে মনে হতে পারে, আরজি করের মামলা বহুল আলোচিত বলেই বোধহয় প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী এবং পরে আদালত ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছে। তা কিন্তু নয়। সোমবার বিচারক স্পষ্টই জানিয়েছেন, টাকা দিয়ে ক্ষতিপূরণ যে হয় না, তিনিও মানেন। কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ কারও দয়া বা সহানুভূতির বিষয় নয়। সরকার নাগরিককে রক্ষা করতে পারেনি, তাই আইন অনুযায়ীই ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। তবে ঘটনা হলো, অনেক সময়েই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি ভুলেই থাকে দায়রা আদালত, যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত একাধিক বার হতাশা প্রকাশ করেছে।
আবার সরকারের তরফে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রেওয়াজ কমই। অথচ, যে কোনও অপরাধে দোষীর শাস্তি নিশ্চিত করা যেমন ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার লক্ষ্য, তেমনই অপরাধের শিকার যিনি (ভিক্টিম বা সারভাইভার), তাঁর পুনর্বাসনের/পরিজনের ক্ষতিপূরণের দায়িত্বও সরকারের।
সেই লক্ষ্যেই ১৯৮৫-র ২৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জ ফৌজদারি আইনে ‘ভিক্টিম’-এর পুনর্বাসন-ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। সেই মতোই ২০০৯–এ ভারতের ফৌজদারি কার্যবিধিতে ৩৫৭ ধারার পরে একটি উপধারা সংযোজিত হয় (৩৫৭এ, অধুনা বিএনএসএস-এর ৩৯৬ ধারা)। যাতে অপরাধ নথিভুক্তির পরে যে কোনও পর্যায়ে যে কোনও আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা আবেদনের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিতে পারে।
খুন-ধর্ষণ, অঙ্গহানি, অ্যাসিড হামলা, মানব-পাচারের মতো ঘটনায় ভিক্টিমের ক্ষতিপূরণে প্রতিটি রাজ্যের কমপেনসেশন স্কিম তৈরিরও কথা। এই স্কিমে ক্ষতিপূরণ পাওয়া ভিক্টিম বা অপরাধের যিনি শিকার, তাঁর আইনসঙ্গত অধিকার, কোনও আপস-অর্থ নয়। ক্ষতিপূরণে সরকারের বাধ্যবাধকতা অপরাধ রুখতে না-পারায় সরকারের এক রকম দণ্ডই।
মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনায় সু্প্রিম কোর্টের নির্দেশে ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি (এনএলএসএ) ক্ষতিপূরণের যে হার তৈরি করেছিল ২০১৮–য়, শিয়ালদহ কোর্টের বিচারক সেই মতোই নির্ধারণ করেছেন ক্ষতিপূরণের অঙ্ক।
এক নজরে দেখে নেওয়া যায় সেই ক্ষতিপূরণের নিয়ম: জীবনহানি ৫-১০ লাখ টাকা। গণধর্ষণ ৫-১০ লাখ। ধর্ষণ, অস্বাভাবিক যৌন নিগ্রহ ৪-৭ লাখ। শরীরের ৮০ শতাংশ ক্ষতি: ২-৫ লাখ। শরীরের ৪০ শতাংশের বেশি ক্ষতি: ২-৪ লাখ। ২০ শতাংশের বেশি ক্ষতি: ১-৩ লাখ। ২০ শতাংশের কম ক্ষতি, মানসিক বা শারীরিক বিপর্যয়: ১-২ লাখ। ভ্রুণ নষ্ট: ২-৩ লাখ। ধর্ষণে অন্তঃসত্ত্বা: ৩-৪ লাখ। অগ্নিসংযোগে শারীরিক ক্ষতি: ২, ৩, ৪, ৫, ৭ বা ৮ লাখ টাকা (ক্ষতির মাত্রা অনুযায়ী)।
এমনিতে ২০১২-র নভেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও নিজস্ব ভিক্টিম কমপেনসেশন স্কিম তৈরি করেছিল। ২০১৭-য় নতুন বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ হয়। এই স্কিমে ক্ষতিপূরণ বণ্টনের দায়িত্ব স্টেট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি (এসএলএসএ) বা জেলাস্তরে ডিস্ট্রিক্ট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি (ডিএলএসএ)–র৷ অর্থ জোগাতে হবে রাজ্যকেই। তবে রাজ্যের স্কিমে বরাদ্দ ক্ষতিপূরণ পর্যাপ্ত নয় মনে করেই কলকাতা হাইকোর্ট এই ক্ষতিপূরণকে ‘অন্তর্বর্তী’ ধরে চূড়ান্ত ক্ষতিপূরণ নির্ণয়ে মোটর ভেহিকেলস আইনের মাপকাঠি মানার নির্দেশ দিয়েছিল বহু আগে।