গৌতম ধোনি, কৃষ্ণনগর
দীর্ঘ দিন দর্জির পেশায় থাকার সময়ে দুটো অভ্যেস রপ্ত করেছিলেন নদিয়ার কৃষ্ণনগরের বাঁকাচাঁদ। এক, অভাব-অনটনকে সেলাইয়ে মুড়ে কী ভাবে জীবনের সঙ্গে ‘ফিটিংস’ করতে হয়। দুই, কাঁচি চালিয়ে বয়সের ঝুলটা কী ভাবে শর্ট করতে হয়। না–হলে ৭৮ বছর বয়সে এসে ভ্যান রিকশা প্যাডেল করতে করতে কুম্ভমেলায় রওনা হওয়ার সাহস আর ক’জনই বা দেখান! তা–ও আবার একা নন, স্ত্রীকে সেই ভ্যান রিকশায় চাপিয়েই কৃষ্ণনগর থেকে রওনা দিয়েছেন তিনি।
প্রতি রবিবার একদম নিয়ম করে সাইকেলপ্রেমী বন্ধুদের নিয়ে ৪০–১০০ কিমি ভ্রমণ করেন বাঁকাচাঁদ। আর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ডাকে ‘নদী বাঁচাও, জল বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে সাইকেল অভিযানের একদম সামনে থাকতে দেখা যায় তাঁকে। এ বার যাচ্ছেন কুম্ভে। তাঁর কথায়, ‘কুম্ভে যাচ্ছি বটে, তবে তীর্থ করতে নয় কিন্তু। নদী বাঁচাও, পরিবেশ বাঁচাও, জল সংরক্ষণ করো — এ সব বার্তা ছড়াতে যাচ্ছি। বছরভর আমি যে অভিযান করি, এটা তারই একটা অঙ্গ।’
আসল নাম দুলাল বিশ্বাস। তবে বাঁকা বা বাঁকাচাঁদ নামেই বেশি পরিচিত তিনি। কৃষ্ণনগরের হাইস্ট্রিটে দর্জির দোকান ছিল তাঁর। বললেন, ‘বছর বারো আগে এই ভ্যান রিকশার ওপরে গ্রিল ঘেরা বক্স শেড বানিয়ে দিয়েছিল বন্ধুরা। সে বার একাই সাইকেলে কামাখ্যা যাব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু স্ত্রী স্বর্ণলতা সঙ্গী হতে চাইলে এড়াতে পারিনি।
এতটা দূরের রাস্তা ওকে সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না বলে বন্ধুরা এটা করে দিয়েছিল। এক বন্ধু তাতে আবার মিউজিক বক্সও লাগিয়ে দিয়েছিল। এ বার তাতেই স্ত্রীকে নিয়ে কুম্ভে যাচ্ছি।’ রবিবার বিকেলে কৃষ্ণনগর থেকে রওনা হন তিনি। আর সোমবার বিকেলে ফোনে বললেন, ‘বর্ধমান ছাড়িয়ে গিয়েছি।’
সারা বছর সাইকেলে এদিক–ওদিক ঘুরে ফসল–জমি, গাছপালা, পুকুর, নদী, পশুপাখি দেখে বেড়ান বাঁকাচাঁধ। শুধু প্রকৃতিই নয়, বিভিন্ন এলাকার মানুষের বিচিত্র সংস্কৃতি, যাপন, জীবন–জীবিকা দেখাও নেশা তাঁর। বললেন, ‘ট্রেন কিংবা রিজার্ভ বাসে করে ঘুরতে বের হলে নিজের মতো কিছু দেখা যায় না। খরচও অনেক বেশি। তাই সাইকেলে বা রিকশায় ঘুরেই দেশ দেখতে ভালোবাসি।’
গত বছর রিকশায় স্ত্রীকে নিয়ে গঙ্গাসাগর গিয়েছিলেন। ঘুরে এসেছেন কামরূপ–কামাখ্যাও। আড়াই মাস ধরে দেড় হাজার কিলোমিটারের সেই সফরে দু’জনে মিলে খরচ হয়েছিল মাত্র দু’হাজার টাকা। বাঁকাচাঁদের সোজা কথা, ‘এ বারও বেশি টাকা নিয়ে বের হইনি। দেশে এখনও বহু ভালো মানুষ আছেন। পথে তাঁরাই বন্ধু হয়ে দাঁড়ান।’
কৃষ্ণনগরে জলঙ্গী, অঞ্জনা নদী বাঁচাও আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত বাঁকাচাঁদ। ‘সেভ জলঙ্গী’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা তাঁর রিকশায় ‘নদী বাঁচাও, মাটি ও জল বাঁচাও, গাছ লাগাও, পরিবেশ বাঁচাও, দূষণকর প্লাস্টিক বর্জন করো, বাই সাইকেল চালাও’ —এ সব বার্তার ফ্লেক্স আটকে দিয়েছেন। একই বার্তা দেওয়া হয়েছে অডিয়ো ক্লিপেও। সেটি যাতে বক্সে বাজে, সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তাঁরা। মহাখুশি বাঁকাচাঁদ। ‘সেভ জলঙ্গী’র প্রাণপুরুষ ডাঃ যতন রায়চৌধুরী থেকে শুরু করে সংস্থার দুই পদস্থ শঙ্খশুভ চক্রবর্তী, শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়–সহ একঝাঁক সদস্য তাঁর যাত্রাপথের পাথেয় জোগাড় করে দিয়েছেন।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বেশি দূর পড়াশোনার সুযোগ পাননি বাঁকাচাঁদ। তবু অন্য অনেকের শিক্ষাগুরু তিনি। কৃষ্ণনগরের এক হোমিয়ো চিকিৎসক সঞ্জয় রাহা বলেন, ‘সাইকেল ভ্রমণে আমার গুরু বাঁকাদা।’ জীবনপুরের পথিক বাঁকাচাঁদ...।