এই সময়: আরজি করের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত সঞ্জয় রায়ে সাজা ঘোষণা করতে গিয়ে রাজ্যে ময়নাতদন্তের চালু দস্তুর এবং পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন শিয়ালদহ আদালতের অতিরিক্তি দায়রা বিচারক অনির্বাণ দাস। সোমবার তাঁর রায়ে বিচারক লিখেছেন, পরিকাঠামো এবং অভ্যাসগত কারণেই ন্যূনতম সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি আরজি করের নির্যাতিতার ময়নাতদন্ত এবং ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে। এমন গুরুতর ধরনের অপরাধের তদন্তে সেই খামতিকে ‘আই ওপেনার’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন বিচারক।
তরুণী চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের নেপথ্যে সঞ্জয় রায় ছাড়া আর কে বা কারা রয়েছে, সেই প্রশ্নে সরব হয়েছিল বিভিন্ন মহল। এই সন্দেহ উসকে দিয়েছিল সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্সে ল্যাবরেটরি (সিএফএসএল)-র একটি রিপোর্ট। সিবিআই-কে দেওয়া সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, নির্যাতিতার স্ননবৃন্ত, যোনিদ্বার ও পায়ু থেকে মেলা যে নমুনা তাদের পরীক্ষা করতে পাঠানো হয়েছিল, তা ছিল কন্টামিনেটেড। মানে, দূষিত বা মিশ্রিত। ওই ডিএনএ প্রোফাইলে মিশে ছিল নির্যাতিতা ও সঞ্জয় ছাড়াও আরও এক মহিলা ও একাধিক পুরুষের ক্রোমোজ়োম। তবে সঞ্জয়ের ডিএনএ মেলা নিয়ে নিঃসংশয় ছিল সিএফএসএল।
এই রিপোর্ট পেয়ে একদিকে যেমন সঞ্জয় ছাড়াও আরও কারও অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহ জোরালো হয়েছিল, তেমনই সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল, ওই নমুনায় ইচ্ছাকৃত ভাবে অনেকের ডিএনএ প্রোফাইলিং নমুনা মিশিয়ে দেওয়া হয়নি তো? আদালতে সঞ্জয়ের আইনজীবীও প্রশ্ন তুলেছিলেন, এমন একটি অনির্ভরযোগ্য ডিএনএ প্রোফাইলে যেন আদালত ভরসা না-করে। এমনকী, সঞ্জয়ও দাবি করেছিল, নির্যাতিতার স্তনবৃন্ত থেকে যে লালার নমুনা মিলেছে সঞ্জয়ের, তা ‘প্লান্ট’ করা হয়েছিল। তার দাবি, পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন পুলিশের প্রহারে তার মুখ থেকে যে লালা বেরিয়েছিল, সেটাকেই নির্যাতিতার স্তনবৃন্তে প্লান্ট করা হয়েছিল।
যদিও সঞ্জয়ের এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন বিচারক। তাঁর সাফ যুক্তি, সঞ্জয় পুলিশ হেফাজতে যাওয়ার বহু আগেই নির্যাতিতাকে দাহ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে নির্যাতিতার একাধিক অঙ্গে যে ভাবে এক মহিলা এবং সঞ্জয় ছাড়াও একাধিক পুরুষের ডিএনএ মিলেছে, তাকে দুর্ভাগ্যজনক পরিকাঠামোগত ত্রুটি বলেই মনে করেছেন বিচারক। এবং সেই সূত্রেই তিনি সরকার ও প্রশাসনের চোখে আঙুল দিয়ে তাঁর রায়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, এমন পরিকাঠামোগত খামতি কী ভাবে একটি সংবেদনশীল ঘটনার তদন্তে প্রভাব ফেলতে পারে।একই সঙ্গে বিচারক দাস রায়ে জানিয়েছেন, ময়নাতদন্তের ভিডিয়ো রেকর্ডিং দেখে তাঁর স্পষ্ট মনে হয়েছে, এই ডিএনএ কন্টামিনেশন কোনও ইচ্ছাকৃত ঘটনা নয়, বরং কিছুটা দুর্ঘটনাবশতই ঘটেছিল। এই প্রসঙ্গেই এ রাজ্যের যে কোনও মেডিক্যাল কলেজের ময়নাতদন্ত সংক্রান্ত পরিকাঠামো ও রেওয়াজকে কাঠগড়ায় তুলেছেন বিচারক। রায়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ— ‘নির্যাতিতার পাশাপাশি একই সঙ্গে মর্গের মেঝেয় পড়ে ছিল একাধিক মহিলার দেহ, ময়নাতদন্তের ট্রে যেমন স্টেরিলাইজ়ড ছিল না, তেমনই ডোমেরা অ্যাপ্রন ও গ্লাভসও বদলাননি দু’টি ময়নাতদন্তের মাঝে।’
শুধু তা-ই নয়। যে গজ ব্যবহার করা হয়েছিল যোনিদ্বার থেকে সোয়াব নমুনা সংগ্রহ করতে, সেটিও অবহেলায় অনাবৃত পড়ে ছিল। এমনকী, স্ক্যালপেল, নাইফ, সিজ়ার-সহ সার্জারির যে সব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছিল নির্যাতিতার দেহ ব্যবচ্ছেদ করতে, সেগুলিকেও স্টেরিলাইজ় করা হয়নি বলে ভিডিয়ো রেকর্ডিং থেকে মনে হয়েছে বিচারকের। এবং এহেন নিকৃষ্ট প্রস্তুতি সম্বল করেই নির্যাতিতার স্তনবৃন্ত, যোনিদ্বার ও পায়ু থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।
ফলে ভিডিয়ো রেকর্ডিং দেখে বিচারকের স্পষ্ট ধারণা হয়েছে, অন্যের শরীরের ডিএনএ মিশে যেতেই পারে নির্যাতিতার ডিএনএ নমুনার সঙ্গে। তবে যে হেতু সমস্যাটা মূলত পরিকাঠামোগত, তাই এর জন্য ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদেরও বিচারক দাস দোষারোপ করতে চাননি বলে লিখেছেন তাঁর রায়ে। কারণ, এই সীমিত পরিকাঠামোতেই তাঁরা ময়নাতদন্ত করতে অভ্যস্ত। কিন্তু এত কিছুর পরেও যে হেতু নির্যাতিতার শরীরের আপত্তিকর স্থানে সঞ্জয়ের ডিএনএ-র নমুনা মিলেছে ষোলো আনা এবং প্রতিরোধের চিহ্ন হিসেবে নির্যাতিতার নখে সঞ্জয়ের দেহকোষ ও সঞ্জয়ের ত্বকের একাধিক কাটা জায়গায় নির্যাতিতার নখের নমুনা মিলেছে, তাই সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করতে অসুবিধায় পড়তে হয়নি বিচারককে।