• অকুস্থল সেমিনার রুমই, নিশ্চিত আদালত
    এই সময় | ২২ জানুয়ারি ২০২৫
  • এই সময়: গত ৯ অগস্ট খুন-ধর্ষণের ভয়াবহ ঘটনাটি কি আরজি করের ক্যাজ়ুয়াল্টি বিল্ডিংয়ের চারতলায় অবস্থিত চেস্ট মেডিসিন বিভাগের সেমিনার রুমেই ঘটেছিল? অকুস্থল নিয়ে এই সন্দেহে ভরা প্রশ্ন বারংবার ঘুরে বেড়িয়েছে নানা মহলে। সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্সে ল্যাবরেটরি (সিএফএসএল)-র রিপোর্টই উসকে দিয়েছিল এ নিয়ে সংশয়। আর সেই সংশয়ের সুযোগ নিয়ে ট্রায়াল চলাকালীন বাঁচতে চেয়েছিল অভিযুক্তও। যদিও শিয়ালদহ আদালতের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক অনির্বাণ দাস সোমবার তাঁর রায়ে সাফ লিখেছেন, ‘সিন অফ ক্রাইম’ নিয়ে তাঁর মনে কোনও সংশয় নেই। এবং অপরাধী সঞ্জয় রায়ই।

    সিবিআই-কে জমা দেওয়া সিএফএসএল-এর রিপোর্টে উল্লেখ ছিল, চারতলার ওই সেমিনার রুমের যেখান থেকে দেহ উদ্ধার হয়, সেখানে প্রতিরোধের কোনও চিহ্ন মেলেনি। অথচ নির্যাতিতা যে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, তার প্রমাণ মিলেছিল অভিযুক্ত সঞ্জয়ের শরীরে নির্যাতিতার আঁচড়ের দাগে। তবে ‘সিন অফ ক্রাইম’–এ প্রতিরোধের চিহ্ন না–মেলায় দেখা দিয়েছিল বড়সড় প্রশ্ন— নির্যাতিতা কি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, নাকি পারেননি? প্রাথমিক ভাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার গোয়েন্দাদের মনেও উঁকি দিয়েছিল সন্দেহ— তা হলে কি সেমিনার রুমে ঘটেনি আসল অপরাধ? কারণ, ধস্তাধস্তি ও প্রতিরোধের চিহ্ন অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের শরীরে মিললেও সেই চিহ্নর কোনও রেশই দেখা যায়নি নির্যাতিতার দেহ যে কার্পেটের উপর পড়ে ছিল, সেখানে। এমনকী, নির্যাতিতার রক্তাক্ত দেহের আশপাশে মেলেনি তাঁর দেহরসও।

    বিচারক দাস অবশ্য সব পক্ষের সওয়াল, বক্তব্য ও পেশ করা তথ্যপ্রমাণ খুঁটিয়ে পরখ করে একপ্রকার নিশ্চিত হয়েছেন, অকুস্থল আদতে ওই সেমিনার রুমই। সেমিনার রুমের কার্পেটে ধস্তাধস্তির চিহ্ন না থাকাকে বিশেষ আমল দেয়নি আদালত। কারণ, সিএফএসএল আধিকারিকরা সেমিনার রুম থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন গত ১৪ অগস্ট, ঘটনার ছ’ দিনের মাথায়। ততক্ষণে কলকাতা পুলিশ-সহ নানা জনের পায়ের ছাপে অনেক সূত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া একেবারেই বিচিত্র নয়।

    তবে সেমিনার রুমের ডায়াসের উপর থেকে উদ্ধার হওয়া দেহের পাশে ভাঁজ করে রাখা কম্বল এবং কার্পেটের উপর যে বেডশিটের উপর শুয়েছিলেন নির্যাতিতা, সেই সবের ছবি দেখে বিচারকের মনে হয়েছে, অকুস্থল অন্যত্র, এমন মনে করার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। বিচারকের যুক্তি, সুরতহালের স্টিল এবং ভিডিয়ো ছবিতেই স্পষ্ট, ঘুমন্ত অবস্থায় আচমকা হামলার শিকার হওয়ায় খুব বেশি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি নির্যাতিতা। তবে সামান্য যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তিনি, তার চিহ্ন বেডশিটেই স্পষ্ট রয়েছে, ছবি দেখে এমনটাই মনে করেছেন বিচারক দাস। কারণ, সঞ্জয় যে মারাত্মক বলপ্রয়োগ করেছিল নির্যাতিতার উপর, তার নানা প্রমাণ ইতিমধ্যে পেশ করা হয়েছে আদালতে।

    ছবি দেখে বিচারকের মনে হয়েছে, কম্বলটি গায়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়নি। বরং সেটি মুড়ে বালিশের মতো ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ, কোনও বালিশের অস্তিত্ব মেলেনি সেমিনার রুমে। আর নির্যাতিতার মাথার ডান পাশে যে হেতু প্লেন জায়গার উপরেই রাখা ছিল মোবাইল, ল্যাপটপ, চশমা ও নোটবুক, তাই সেগুলি অক্ষত থেকেছে। কিন্তু জলের বোতলটি উল্টে গিয়েছে ধস্তাধস্তির জন্যই। তাই অকুস্থল যে সেমিনার রুম, তা নিয়ে বিচারকের মনে কোনও বিভ্রান্তি ছিল না বলেই রায়ে লিখেছেন তিনি।

    যদিও সেমিনার রুমই অকুস্থল কি না, সে প্রশ্ন উঠতে, তদন্ত এবং তথ্যপ্রমাণের ফাঁক নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিজেকে নির্দোষ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিল সঞ্জয়। কিন্তু তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে গিয়ে তার জিনসের প্যান্টে মৃত চিকিৎসকের রক্ত ও দেহরস এবং তার শরীরে নির্যাতিতার প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডিএনএ রিপোর্টকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ বলে মনে করেছেন বিচারক।

  • Link to this news (এই সময়)