রাতুল ঘোষ:স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাংবাদিকতার ইতিহাসে প্রয়াত বরুণ সেনগুপ্তের সমকক্ষ ব্যক্তিত্ব আর দ্বিতীয়টি আসেননি। শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজের প্রত্যয়ে অবিচল থেকে মাথা উঁচু করে দীর্ঘদিন সৎ সাংবাদিকতায় নিমজ্জিত ছিলেন।
কলেজ জীবনে তিনি ‘ভাবীকাল’ বলে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তারপর ‘অজাতশত্রু’ জননেতা হেমন্ত বসুর কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে প্রকাশ করেন ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’ পত্রিকা। যা প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখার জন্য একসময়ে রমরমিয়ে চললেও মামলা মোকদ্দমায় জেরবার হয়ে শেষ পর্যন্ত কাগজটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন বরুণবাবু। তাঁর স্বপ্নের সেই ‘বর্তমান’ দৈনিক অবশেষে আত্মপ্রকাশ করেছিল ১৯৮৪ সালের ৭ ডিসেম্বর।
অদ্ভুত দূরদৃষ্টি ছিল বরুণবাবুর। কাকে দিয়ে কোন কাজটা হবে, সেটাও বিলক্ষণ বুঝতেন। ‘বর্তমান’ যখন শুরু হয়েছিল, তখন ছিল ট্রাঙ্ককলের যুগ। তারপর এল এসটিডি। ভোর পাঁচটায় ‘বর্তমান’ পত্রিকার অফিসে (জোড়াগির্জার বিপরীতে) ঢুকতেন। সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটার মধ্যে সেদিনের প্রভাতী সংবাদপত্রগুলির পাতায় চোখ বোলানোর ফাঁকে অন্তত জনা পঞ্চাশেক লোককে ফোন করতেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন দিল্লি ও কলকাতার নামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, গুরুত্বপূর্ণ আমলা, বিশেষ সোর্স এবং ‘বর্তমান’ ও অন্যান্য কাগজের প্রথম সারির নামী সাংবাদিক। সারাদিনে বিবিধ মিটিং সেরে কাগজ সম্পাদনা করে অফিস ছাড়তেন রাত ১১টা নাগাদ। এই রুটিন প্রথম দশ বছর তিনি অবলীলাক্রমে চালিয়ে গিয়েছেন। কাউকে বুঝতে দেননি, তাঁর শরীর ভাঙছে।
১৯৬০-’৬১ সালে বরুণবাবুর আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগদান। অচিরেই তিনি বাংলা সাংবাদিকতায় প্রথম ‘রাজনৈতিক সংবাদদাতা’র শিরোপা পান। তাঁর লেখা ‘রাজ্য রাজনীতি’ কলাম পাড়ায় পাড়ায় চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে আপামর বাঙালির হেঁশেলে ঢুকে পড়েছিল। এত জনপ্রিয় রাজনৈতিক কলাম আর কেউ লিখতে পারেননি। আর এর নেপথ্যে ছিল তথ্য, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, কথ্য ভাষায় প্রকাশভঙ্গির ঈর্ষণীয় মুন্সিয়ানা। কখনও জটিল ভাষা ব্যবহার করেননি তিনি।
জাতীয় ও রাজ্য রাজনীতির অন্ধকার দিকগুলি উন্মোচন করে বহু গোপন তথ্য তিনি পাঠকদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন। সে সাহস আজ আর কেউ দেখান না।
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে লড়াই করে নিজের বক্তব্যে অবিচল থেকে সংবাদপত্র চালাতে হয়, তা বরুণবাবু দেখিয়ে দিয়েছেন।
নৈতিকতার জোরেই আজীবন আপসহীন কলম চালাতে পেরেছিলেন বরুণবাবু। সাংবাদিকতা ছিল তাঁর কাছে একটা মিশন। আর এর জোরেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাংবাদিকতার মহীরুহ।