গোকুল গঙ্গোপাধ্যায়: ‘বর্তমান’ কাগজের জন্য মেশিন কেনা হবে। তার জন্য যেতে হবে সুদূর জার্মানি। ‘বর্তমান’ প্রতিষ্ঠাতা তথা তৎকালীন সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্ত আমাকে ডেকে বললেন, জার্মানি যাওয়ার পরিকল্পনার কথা। আমার তো মাথায় বজ্রাঘাত! কখনও বিদেশ যাওয়ার কথা চিন্তাই করিনি, তাই পাসপোর্ট ইত্যাদি কিছু নেই। সব ব্যবস্থা তিনিই করে দিলেন। প্রসেসিং ও সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের আরও দু’জনের সঙ্গে আমিও বরুণবাবুর সঙ্গী হয়ে গেলাম। গন্তব্য জার্মানির প্রিন্টিং এগজিবিশন। মেশিন যেখানে অ্যাসেম্বল হয়, সেখানেও যাওয়া হল। জার্মানি গিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। ওখানে সসেজ ইত্যাদি খাওয়া হয়। আমি ব্রাহ্মণ সন্তান, কী না কী মাংস খেতে ইতস্তত করছি। ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন বরুণবাবু। তিনি আমার এক সহকর্মীকে বললেন, ‘গোকুলবাবু তো মনে হচ্ছে এই খাবার খাবেন না। তুমি বরং ওঁকে একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে নিয়ে এসো।’ সেই সময় ওখানে ভারতীয় খাবারের দাম বেশ চড়া। তাও তিনি কোনওরকম কার্পণ্য করেননি। শুধু জার্মানির ওই ঘটনাটিই নয়, পরবর্তীকালেও দেখেছি, কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধার দিকে বরুণবাবুর সর্বদা তীক্ষ্ণ নজর ছিল। আর ছিল বড় মন।
বরুণ সেনগুপ্তকে আমি কখনও ‘স্যার’, আবার কখনও ‘বরুণদা’ বলে ডাকতাম। আমার ‘বর্তমান’-এ যোগদান বা বরুণদার সঙ্গে আলাপ বেশ আকস্মিক। আমি চাকরি করতাম এলাহাবাদে। হঠাৎ পিতৃবিয়োগ হওয়ায় সেই চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসতে হয়। সেই সময় ‘বর্তমান’ কাগজ বের করার তোড়জোড় চলছে। আর আমিও হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছি। ‘বর্তমান’-এ প্রথম প্রিন্টিং ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন তাপসবাবু। উনিই হাতে ধরে আমাকে ‘বর্তমান’-এর পুরনো অফিস অর্থাৎ এ জে সি বোস রোডের দপ্তরে নিয়ে যান। বরুণদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমিও সেখানে কাজে যোগ দিই। তখনও কিন্তু কাগজ প্রকাশিত হয়নি। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি তুঙ্গে। কাগজ প্রকাশের ঠিক এক সপ্তাহ আগে প্রিন্টিং ম্যানেজার তাপসবাবু ইস্তফা দিলেন। স্বভাবতই বরুণদাও প্রচণ্ড আতান্তরে পড়লেন। চিন্তিত বরুণদা ওঁর চেম্বারে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘কাগজ কীভাবে বেরবে?’ বলেছিলাম, ‘আপনার আশীর্বাদের হাত মাথার উপর থাকলে যেদিন কাগজ বেরনোর কথা, ঠিক সেদিনই কাগজ বেরবে।’
সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় ১৯৮৪ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্দিষ্ট দিনেই প্রকাশিত হল নতুন দৈনিক— ‘বর্তমান’। তিনি যত বড় সাংবাদিক-সম্পাদক, ঠিক তত বড় মাপের মানুষ। বরুণদা আমার কাছে যুগপুরুষ।