এই সময়: আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক–ছাত্রীকে ধর্ষণ–খুনের ঘটনার পর পাঁচ মাস পেরিয়ে গিয়েছে। ধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করে আমৃত্যু কারাবাসের শাস্তিও ঘোষণা করেছেন শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস। কিন্তু একটি প্রশ্ন এতদিন সকলকে ভাবিয়েছে— সঞ্জয় কেন এমন একটা ঘটনা ঘটাল? এর পিছনে কী মোটিভ ছিল তার?
কেবল সাধারণ মানুষকে নয়, সেই প্রশ্ন বিচলিত করেছিল বিচারককেও। কিন্তু আগাগোড়া ঘটনা পরম্পরা ও তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে তাঁর মনে হয়েছে, কোনও নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট মোটিভ ছিল না কলকাতা পুলিশের ওই বরখাস্ত হওয়া সিভিক ভলান্টিয়ারের।
বরং, তাৎক্ষণিক আবেগ ও মত্ত অবস্থায় জৈবিক প্রবৃত্তির টানেই ওই ভয়ঙ্কর ঘটনা সঞ্জয় রায় আচমকা ঘটিয়ে ফেলেছিল বলে বিচারক মনে করেছেন। সে কথা ১৭২ পাতার রায়ে লিখতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, অপরাধীর সঙ্গে নির্যাতিতার কোনও পূর্ব পরিচিতি ও সম্পর্ক যেমন ছিল না, তেমনই এমন ঘটনা ঘটানোর কোনও পূর্ব পরিকল্পনাও তার ছিল না। ফলে, কোনও রকম প্রতিশোধস্পৃহার তত্ত্বও উড়িয়ে দিয়েছেন বিচারক।
বিচারক তাঁর রায়ে উল্লেখ করেছেন, এমন একটা নারকীয় ঘটনা সঞ্জয় কী ভাবে ঘটাল, সেটা বোঝার জন্য ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে, ৮ অগস্ট রাতের ঘটনা পরম্পরার দিকে খেয়াল করতে হবে। চেতলায় গিয়ে আকণ্ঠ মদ্যপানের কথা সঞ্জয় স্বীকারও করে নিয়েছে। এবং ভয়ঙ্কর মত্ত অবস্থায় সে আরজি কর হাসপাতালে ঢুকে চারতলায় পৌঁছেছিল।
তবে অকুস্থল হিসেবে তদন্তে প্রতিষ্ঠিত চারতলার সেমিনার রুমে সে যে ঢোকেনি, তার কোনও অকাট্য প্রমাণ সে আদালতে পেশ করতে পারেনি। তাই, বিচারক মনে করেছেন, তরুণী চিকিৎসককে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আদিম প্রবৃত্তির বশে আচমকা ঝোঁকের মাথায় সে ওই ভয়াবহ কাজ করেছে। তখনই সে নির্যাতিতার উপর হামলা চালায়। আর তার লালসা মেটাতে গিয়েই এমন ভয়ঙ্কর, মর্মান্তিক পরিণতি।
বিচারক মনে করেছেন, এই ঘটনা পরম্পরার মধ্যে একটা জিনিস স্পষ্ট যে, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চারতলার ওই চেস্ট মেডিসিন ওয়ার্ড এবং সেখানকার সেমিনার রুমের দ্বার প্রায় অবারিত ছিল বহিরাগতদের জন্য। নিহত তরুণী চিকিৎসকের এক সতীর্থের সাক্ষ্যেই উঠে এসেছে সে কথা।
তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুন হওয়ার দিন, ৯ অগস্টের আগে একদিন সেই মহিলা (নিহত তরুণীর সতীর্থ) চিকিৎসকও ওই সেমিনার রুমে যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তখন আচমকা এক মদ্যপ ব্যক্তি সেখানে ঢুকে পড়ে। তিনি আদালতকে জানান, ভয়ে সে দিন তিনি চিৎকার করে ওঠায় ওই ব্যক্তি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বিষয়টি তিনি বিভাগীয় প্রধানকেও জানিয়েছিলেন— এমনটা ওই মহিলা বলেন আদালতক। এ সব কথাই বিচারক দাস উল্লেখ করেছেন তাঁর রায়ে।
শুধু তা-ই নয়, সঞ্জয়ের এই নির্দিষ্ট কোনও মোটিভ না–থাকা যে অস্বাভাবিক ও নজিরবিহীন নয়, সে কথার সপক্ষে শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। নির্দিষ্ট কোনও মোটিভ ছাড়াও অনেক সময়ে অপরাধী যে আচমকা ঝোঁকের মাথায় ভয়ঙ্কর কোনও অপরাধ ঘটিয়ে ফেলতে পারে, সে কথার সপক্ষে তিনি উদ্ধৃত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের একাধিক মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণের।
সেই সব মামলার মতো আরজি করের ধর্ষণ ও খুনের মামলাতেও স্পষ্ট কোনও মোটিভ থাকার প্রমাণ মেলেনি বলে জানিয়েছেন বিচারক দাস। তবে তিনি মনে করেন, পারিপার্শ্বিক আরও যে সব তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, সে সবের জন্যই মারাত্মক অপরাধের পিছনে এই স্পষ্ট মোটিভ না–থাকা কোনও ভাবেই লঘু করে না মামলাটিকে।
বিচারক দাস তাঁর রায়ে সেমিনার রুমের অদূরের ঘরে পূর্ত দপ্তর যে সংস্কার ও নির্মাণকাজ শুরু করেছিল, সেই প্রসঙ্গও তুলেছেন। তবে ওই ঘরটি তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার জন্য ভাঙা হয়েছিল, এমন তত্ত্বে সায় দেননি বিচারক। তাঁর যুক্তি, ওই ঘরে ইট-সিমেন্ট-বালি-রাবিশের যে ধ্বংসাবশেষ পড়ে ছিল, তা খুঁটিয়ে পরখ করেছেন সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি (সিএফএসএল)-র বিশেষজ্ঞরা এবং সেই ধ্বংসাবশেষে দেহরস কিংবা অন্য কোনও জৈব পদার্থের চিহ্ন মেলেনি।