জাল নথি তৈরি করে দাগি দুষ্কৃতীদের জামিন পাইয়ে দিয়ে হাজত থেকে তাদের বার করে আনা হচ্ছে, এমনটাই অভিযোগ। আলিপুরদুয়ার আদালতে সেই জাল নথি তৈরির আঁতুড়ঘরের সন্ধান মিলল কলকাতা হাইকোর্টের জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চেই দায়ের হওয়া একটি মামলার প্রেক্ষিতে। তবে এ ব্যাপারে গুরুতর অভিযোগ পেয়ে হাইকোর্ট নির্দেশ দেওয়ার পরেও তদন্তে আলিপুরদুয়ারের পুলিশ সুপারের ভূমিকা নিয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ বিচারপতি জয়মাল্য বাগচি ও বিচারপতি গৌরাঙ্গ কান্তের ডিভিশন বেঞ্চ।
পেশায় আইনজীবী এক ‘প্রফেশনাল শিওরিটি’র (পেশাদার জামিনদার) প্রায় তিন হাজার সই জাল করে হেফাজতে থাকা অভিযুক্তদের জামিন পাইয়ে দেওয়ার পিছনে আলিপুরদুয়ার আদালত চত্বরে জাল নথির তৈরির একটি চক্র অর্গানাইজ়্্ড ক্রাইম করছে বলে নিশ্চিত বিচারপতি বাগচির ডিভিশন বেঞ্চ।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে এই তদন্তের জন্য আলিপুরদুয়ারের পুলিশ সুপার ওয়াই রঘুবংশীকে নির্দেশ দেওয়ার পরেও মঙ্গলবার জমা পড়া পুলিশের রিপোর্ট দেখে কার্যত হতবাক হাইকোর্ট। আদালতের বক্তব্য, একজন দক্ষ তদন্তকারী অফিসারকে দিয়ে তদন্ত করানো এবং জেলার এসপি–কে সেই গোটা তদন্তে আদালত নজরদারির নির্দেশ দিয়েছিল। অথচ পুলিশের রিপোর্ট থেকে এটা স্পষ্ট যে, এর মধ্যে পুলিশ সুপারের নজরদারির কোনও ইঙ্গিত নেই।
বিচারপতি বাগচির মন্তব্য, ‘এটা শুধু সই জাল করার ব্যাপার নয়। সেই নথি কে ব্যবহার করেছে, কে সার্টিফাই করেছে, ব্যাঙ্কের চেক কার— এ সবেরই তদন্ত করে দেখার কথা এসপি–র। কিন্তু তিনি সে সব কিছুই করেননি।’ এই অবস্থায় হাইকোর্ট পুলিশি তদন্তের অগ্রগতির সবিস্তার রিপোর্ট তৈরি করে এসপি–কে তা খতিয়ে দেখে ২৯ জানুয়ারি জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। মামলার তদন্তকারী অফিসারকেও ওই দিন হাজিরার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
ধর্ষণে অভিযুক্ত থেকে মাদক পাচার চক্রে জড়িত হিসেবে একাধিক বার ধরা পড়া— জাল নথি তৈরি করে এ রকম দাগিদের জামিন পাইয়ে দেওয়ায় অভিযোগে আইনজীবীদের একাংশের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে সার্কিট বেঞ্চে। আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ, ‘অভিযুক্ত যিনিই হোন, তাঁকে গ্রেপ্তার করতে হবে পুলিশকেই। কালো গাউন কাউকে অপরাধ করার অনুমতি দেয় না। যত বড় আইনজীবী হোন না কেন, অপরাধ করলে তাঁকে গ্রেপ্তার করায় কোথাও বাধা নেই।’ আলিপুরদুয়ারের পুলিশ সুপারকে এ ব্যাপারে এক রকম শেষবারের মতো সতর্ক করে দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ।
সুখেন্দ্রনাথ বণিক নামে এক আইনজীবী জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চে মামলা করে জানান, ১৯৯৯ সালে তিনি ল’ পাশ করে পরের তিন-চার বছর প্র্যাকটিস করেন। সেই সময়ে তিনি প্রফেশনাল শিওরিটি বা পেশাদার জামিনদার হিসেবে বন্ড দিতেন। তার পর আর তিনি পেশাদার জামিনদার হিসেবে কোনও কাজ করেননি। কিন্তু কোনও এক অভিযুক্ত জামিন পাওয়ার পর বেপাত্তা হয়ে গেলে সুখেন্দ্রনাথকে অভিযুক্ত করা হয়। কারণ, সেই অভিযুক্তর ক্ষেত্রে বন্ড তিনিই দিয়েছিলেন, এমনটা অভিযোগ ওঠে। সুখেন্দ্রনাথ প্রমাণ পেশ করে জানিয়ে দেন, এ রকম কাউকেই তিনি বন্ড দেননি। আর তার পরেই বেরিয়ে আসে জালিয়াতির চক্র। এটা স্পষ্ট হয় যে, সুখেন্দ্রনাথের সই জাল করে একটি চক্র অভিযুক্তদের জামিন পাইয়ে দিচ্ছে— সে ক্ষেত্রে বন্ড–ও স্বভাবতই জাল।
আদালত সূত্রের খবর, সুখেন্দ্রনাথ ২০২২ সালে প্রথম অভিযোগ দায়ের করেন আলিপুরদুয়ার থানায়। কিন্তু থানা এফআইআর করে তদন্ত করেনি। পরবর্তীতে তিনি হাইকোর্টে গেলে সিঙ্গল বেঞ্চ তাঁর আবেদন খারিজ করে দেয়। তবে তার পর ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয় হাইকোর্টে। প্রথমে বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডনের ডিভিশন বেঞ্চ ও তার পর বিচারপতি দেবাংশু বসাকের ডিভিশন বেঞ্চ ওই ব্যক্তির অভিযোগে গুরুতর অভিযোগ খুঁজে পায়।
বিচারপতি বাগচি মঙ্গলবার পুলিশের রিপোর্ট দেখে জানান, আলিপুরদুয়ার আদালত চত্বরেই একটা র্যাকেট এই জাল নথি তৈরি করে জামিনের জন্য ব্যবহার করছে।
এই মামলায় আলিপুরদুয়ার জেলা জজের তরফে সার্কিট বেঞ্চে জমা দেওয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, মামলাকারীর নামে ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৯৫৪টি বেল বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। নথি পরীক্ষা করে সিআইডি জানায়, সই জাল করা হয়েছে মামলাকারীর। মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়ে বীরপাড়া মোড়ে ওই ব্যক্তির বাড়িতে হামলার অভিযোগ ওঠায় তাঁর বাড়িতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পুলিশকে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে।