• বাংলার মাঠ থেকে দিল্লির রাজপথে ‘বর্ণালী’ উড়ান, পাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার
    এই সময় | ২৪ জানুয়ারি ২০২৫
  • এই সময়, কুলপি: দূরত্ব প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার। নিছক পথের? না। শ্রম আর সম্মানের। বাংলার দক্ষিণ প্রান্তের এক পল্লি থেকে যে ‘বর্ণালী’ লড়াই শুরু হয়েছিল, তা–ই পূর্ণতা পাবে রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসে। নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে।

    লড়াইটা কুলপির অশ্বত্থতলার বর্ণালী ধাড়ার। স্বামীর সারের দোকান দেখভাল করতে করতে যিনি এই বছর কৃষিক্ষেত্রে দেশের সেরা দশ নারীর একজন। রবিবার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু তাঁর হাতে তুলে দেবেন ‘উদ্যোগী কৃষক’ পুরস্কার। দেশের ১০ জন মহিলা এই পুরস্কার পাবেন। বাংলা থেকে একমাত্র বর্ণালী।

    আর পাঁচটা গৃহবধূর মতো শুরুটা হয়েছিল সাদামাটা ভাবেই। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপির বর্ণালীর স্বামী পেশায় স্কুল শিক্ষক হলেও তাঁর সার, বীজের দোকান ছিল। বর্ণালীর বাবা–মাও শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কাকদ্বীপে বাপের বাড়িতে পড়াশোনার আবহের মধ্যেও ছোট থেকে চাষবাসের প্রতি ঝোঁক ছিল বর্ণালীর। পরিবারে গো–পালন, ধান চাষ হতো। ছিল আনাজের বাগানও। বিয়ের পরে কুলপিতে স্বামীর বীজ–সারের দোকান সামলাতে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কথাবার্তা বলার সুযোগ আসে। আরও ভালো করে বুঝতে পারেন কোথায় সমস্যা। সুরাহা নিয়ে চিন্তাভাবনা তখন থেকেই। সময়ের সঙ্গে সেটাই বদলে দেয় তাঁর জীবন। আর তাঁর হাত ধরে আলো ফোটে আরও হাজার হাজার মুখে।

    প্রথাগত চাষ সম্পর্কে বর্ণালীর ধারণা ছিলই। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন, তথাকথিত ‘এক্সট্রা মাইল’ তাঁকে অতিক্রম করতে হবে। শুরু করেন কৃষি নিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়া। তার পরে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী ‘অশ্বত্থতলা জনকল্যাণ মহিলা সমিতি’। স্বনির্ভর করে তোলেন এলাকার কয়েক হাজার মানুষকে। সুন্দরবন এলাকায় বছর পঞ্চাশের বর্ণালীর এই কর্মকাণ্ড সরকারের নজর এড়ায়নি। তারই পুরস্কার তিনি পাবেন রবিবার। রাষ্ট্রপতি ভবনের চিঠিও এসে পৌঁছেছে বর্ণালীর বাড়িতে।

    কৃষিকে কেন্দ্র করে নতুন দিশার খোঁজে বর্ণালী প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন নিমপীঠ কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে। সেটা ২০১৭ সাল। প্রশিক্ষণ শেষে গ্রামে গড়ে তোলেন ফার্মার্স প্রোডিউসার কোম্পানি (এফপিসি) এবং ফার্মার্স ইন্টারেস্ট গ্রুপ (এফআইজি)। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কৃষি বিষয়ক একাধিক প্রকল্পের কথাও জানতে পারেন। শুরু হয় সরকারি প্রকল্প কাজে লাগিয়ে চাষবাস, হাঁস, মুরগি, ছাগল, গো–পালন। বর্ণালীর হাতে তৈরি ‘অশ্বত্থতলা জনকল্যাণ মহিলা সমিতি’–র সদস্য বাড়তে থাকে। বর্তমানে দু’হাজারের বেশি মহিলা তাঁর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সকলেই স্বনির্ভর হচ্ছেন।

    বীজ, জৈব সার, সেচ ব্যবস্থা নিয়ে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন পুরুষ ও মহিলারা। কৃষি ও হাতের কাজকে সম্বল করে স্বনির্ভর হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। বর্ণালী বলেন, ‘স্বামীর সারের ব্যবসা সামলাতে গিয়ে এলাকার বহু কৃষকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের চাষবাসের ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা হচ্ছে জানলাম। তার পরেই কৃষি কাজের উপরে নিমপীঠ কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি।’ ওই কেন্দ্র থেকেই প্রথমে বীজ প্রোডাকশন শেখেন বর্ণালী। তার পর এলাকার চাষিদের নিয়ে ১০০ বিঘা জমির উপরে বীজ তৈরি শুরু করেন। সেই বীজ কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রি করে উপকৃত হন চাষিরা।

    পাশাপাশি মুসুর দানা, সূর্যমুখীর মতো বিভিন্ন বিকল্প চাষের মাধ্যমে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর প্রায় দু’হাজার মহিলাকে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে দিতে পেরেছেন বর্ণালী। বিভিন্ন যোজনার মাধ্যমে চাষবাস করে স্বনির্ভর হয়েছেন আরও ১০ হাজার চাষি। আগামী দিনেও চাষবাসের মধ্যে দিয়ে সমাজের আরও মহিলা এবং চাষিকে স্বনির্ভর করার চেষ্টা করার স্বপ্ন দেখেন বর্ণালী।

    রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য প্রথম ফোনটা পেয়ে বিশ্বাস করতে পারেননি। বর্ণালীর কথায়, ‘পরে যখন পোস্ট অফিসের তরফে বেশ কয়েকজন এবং দিল্লি দূরদর্শনের লোকজন আমার বাড়িতে আসেন এবং আমাকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র দেন, তখন বুঝলাম সত্যি সত্যি আমি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাচ্ছি। কষ্ট করলে সাফল্য একদিন আসবেই।’

    ছুটে চলেছে স্বপ্নের ‘বর্ণালী’। পল্লি প্রান্তর পেরিয়ে রাজপথ — সাফল্যের এক অনন্য মাইলস্টোন লিখে চলেছেন বাংলার বধূ।

  • Link to this news (এই সময়)