প্রদীপ্ত দত্ত, ঝাড়গ্ৰাম: কাঁকড়াঝোরের জঙ্গলে কি ঘাঁটি গেড়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার? শুক্রবার এই প্রশ্নকে ঘিরে তোলপাড় চলল গোটা ঝাড়গ্রাম জেলায়। কেননা, হাঁড়িডাহার জঙ্গলের পর বাঘের পায়ের ছাপ মিলেছে কাঁকড়াঝোরে। একটি কিংবা দু’টি নয়, একাধিক। তা দেখে বাসিন্দারা একপ্রকার নিশ্চিত ডেরা বদল করেছে ডোরাকাটা। হাঁড়িডাহা ছেড়ে সে এখন কাঁকড়াঝোরে। স্বাভাবিকভাবেই ঘুম উড়েছে জেলাবাসীর। উদ্বিগ্ন জেলা বনদপ্তরও। বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে মাইকিং করা হচ্ছে ভুলাভেদা রেঞ্জের তরফে।
বাঘিনী জিনাত গত ডিসেম্বরের গোড়ায় ওড়িশা থেকে ঝাড়খন্ডের চাকুলিয়া হয়ে কাঁকড়াঝোরের জঙ্গলে ঢুকেছিল। বনকর্মীদের নাকানিচোবানি খাইয়ে অবশেষে ধরা পড়ে বাঁকুড়ার জঙ্গলে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জঙ্গলমহল। সেটা আর বেশিদিন স্থায়ী হল না। চলতি জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখে পুরুলিয়ার সীমানা ঘেঁষা হাঁড়িডাহার জঙ্গলে ফের বাঘের পায়ের ছাপ মেলে। কিন্তু বাঘের গলায় রেডিও কলার না থাকায় তার গতিবিধি নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে বনকর্তারা। শুধু তাই নয়, বেলপাহাড়ীর জঙ্গলে বাঘের ঘন ঘন যাতায়াত তাঁদের মাথা ব্যাথারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও ঝড়গ্রামের জঙ্গলগুলিতে বারবার বাঘের পায়ের ছাপ মিলছে কেন? তারা আসছে কোন পথে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওড়িশার সিমলিপাল, ঝাড়খন্ডের চাকুলিয়া রেঞ্জের সঙ্গে ঝাড়গ্ৰামের কাঁকড়াঝোর পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের জঙ্গলের ভূপ্রকৃতিগত মিল রয়েছে। বাঘ সাধারণত পর্যাপ্ত খাবার, পানীয় জল, আশ্রয় ও বিশ্রামের খোঁজে ১০ থেকে ১৫ বর্গ কিমি এলাকাজুড়ে বিচরণ করে। তাই বনকর্তারা মনে করেন, সিমলিপাল, ঝাড়খণ্ডের দলমা ও হাজারিবাগের জঙ্গল থেকে বেলপাহাড়ীর জঙ্গলে বাঘের বিচরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ভুলাভেদা, কাঁকড়াঝোর, বেলপাহাড়ীর জঙ্গলে পর্যায়ক্রমে ৩২টি হরিণ ছাড়া হয়েছিল। দু’দশকে আগের থেকে হরিণের সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়াও ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়ার সীমান্তবর্তী জঙ্গলে খরগোশ ও বনশূয়োরের দেখা মেলে। স্থানীয় গ্ৰামবাসীদের ছাগলও জঙ্গল এলাকায় চরে বেড়ায়। এইসব সহজলভ্য খাবারের সন্ধানে বাঘ আসার সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ২০১৮ সালে ওড়িশার সিমলিপাল থেকে লালগড়ের জঙ্গলে বাঘ ঢোকার স্মৃতি এখনও মানুষের মনে তাজা। সিমলিপাল অভয়ারণ্যে এখন ২৭টি বাঘ রয়েছে। মূলত, সেখান থেকে বাঘ ঝাড়গ্রাম সহ সংলগ্ন জঙ্গল এলাকায় চলে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু ২০১৮ সালের পর এই প্রথম বাঘের আনাগোনা এতবেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তার প্রভাব পড়ছে জঙ্গলমহলের স্বাভাবিক জনজীবনেও।
এদিন কথা হচ্ছিল বেলপাহাড়ীর মনিয়ারডি গ্ৰামের বাসিন্দা ধীরেন মূর্মুর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের এই জঙ্গলে বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। জঙ্গলের পথে বাঘের পায়ের ছাপ মিললেও লোকালয়ে অবশ্য বাঘ দেখা যায়নি।’ এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই জঙ্গল নির্ভর। সিংহভাগ গ্রামবাসীর পেট চলে কুরকুট (লাল পিঁপড়ে)-এর ডিম, শালাপাত ও গাছের কন্দ সংগ্রহ করে। বাঘের আতঙ্কে তাঁরা এখন জঙ্গলে ঢোকার সাহস পাচ্ছেন না। বাঘের দেখা মানেই জীবন শেষ! বনবিভাগের কর্মীরা অবশ্য ক’দিন ধরে মাইকিং করে সতর্ক করছেন। বিনপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বিকাশচন্দ্র সরকার বলেন, ‘বাঘটি সম্ভবত ঘুরপথে এই জঙ্গল এলাকায় ঢুকেছে। জঙ্গল লাগোয়া গ্ৰামবাসীদের সতর্কভাবে চলাফেরা করতে বলা হচ্ছে। জঙ্গলে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে।’ ভুলাভেদা রেঞ্জের এক অফিসার বলেন, ‘জঙ্গল এলাকা পরিদর্শন করা হচ্ছে। গ্ৰাম বাসীদের সতর্ক থাকতে মাইকিং করে প্রচার করা হচ্ছে।’ কিন্তু, সতর্ক-সচেতন করলে তো আর পেট ভরবে না—আক্ষেপ ধীরেনবাবুদের।