১৪ ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি কাগজটার নীচের দিকের অনেকটা অংশ কোনও সময়ে জলে ভিজেছিল। তারই লালচে ছোপ স্পষ্ট। ভাগ্যিস, মেটাল ব্লক ব্যবহার করে ওই কাগজে সাড়ে ন’ ইঞ্চি বাই সাত ইঞ্চি মাপের যে ছবিটা ছাপা হয়েছিল তার কোনও ক্ষতি হয়নি ওই জলে! বহু বছর রাজস্থানের কোটা শহরের কোনও হাভেলির দেওয়ালে ঝুলেছিল ছবিটা। তারপর ওটার সন্ধান পান কলকাতার সংগ্রাহক সৌভিক রায়। ছবিটা কলকাতায় নিজের বাড়িতে আনানোর ব্যবস্থা করেন। ওই ছবি যাঁর, তিনি গহর জান।
শুধু ভারতের নন, তাঁকে অনায়াসে গোটা এশিয়ার প্রথম ‘পোস্টার ব্যক্তিত্ব’ বলাই যায়। পাশাপাশি তাঁর পরিচিতি ভারতের প্রথম ‘কোটিপতি’ গায়িকা হিসেবে। নিজের সময়ে তাঁর যে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল, তার পাল্লা বোধহয় খুব কম জনই দিতে পেয়েছিলেন।
বর্ণময় সেই গহরের অতি বিরল মেটাল ব্লক প্রিন্টের একটি ছবি প্রদর্শিত হতে চলেছে বেহালার সাবর্ণ সংগ্রহশালায়, ১৯তম কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল হিস্ট্রি অ্যান্ড হেরিটেজ এগজ়িবিশনে। সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদের উদ্যোগে এই প্রদর্শনীটি আয়োজিত হচ্ছে ৯ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি।
কোনও রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক নেই অথচ সম্পত্তির পরিমাণ এক কোটি টাকারও বেশি। ১৯২০–র দশকের এমন ভারতীয়ের তালিকা করতে বসলে যে ক’জনের নাম পাওয়া যাবে, তাঁদের অন্যতম গহর জান। গ্রামাফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া যখন ভারতীয় শিল্পীদের গাওয়া গানের রেকর্ড তৈরি শুরু করে, সেই সময়ে একেবারে প্রথম যে শিল্পীদের গান রেকর্ড হয়েছিল, গহর জান তাঁদের অন্যতম।
তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম ‘রেকর্ডিং সুপারস্টার’ এবং ‘দ্য গ্রামাফোন গার্ল’। ১৯০২ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত অন্তত ১০টি ভাষায় তিনি ৬০০–র বেশি গান রেকর্ড করেছিলেন। ৭৮ আরপিএম–এর ওই রেকর্ডগুলো বাজার মাতিয়েছিল। দেশের ‘প্রথম সুপারস্টার’ গহরের জীবনের অনেকটা সময় কেটেছিল কলকাতার কলুটোলায়।
শোনা যায়, ১৯৫০–এর দশকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা মহম্মদ রফি বা লতা মঙ্গেশকর একটি গান রেকর্ডিংয়ের জন্য ৫০০ টাকা পেতেন। ৭৫ বছর আগে সেটা বিপুল টাকা। আর তারও ৩০ বছর আগে ১৯২০–র দশকে? সেই সময়ে গহর জান একটা গান রেকর্ড করতে নাকি ৩ হাজার টাকা নিতেন। প্রখ্যাত ওই শিল্পীর ফোটোর অভাব নেই। তবে বেহালার প্রদর্শনীতে যেটি দেখা যাবে, সেটি ফোটো নয়, মেটাল ব্লক প্রিন্ট। ১৯২০–র দশকে খুবই জনপ্রিয় ছিল মেটাল ব্লকের সাহায্যে তৈরি ছবি।
সংগ্রাহক সৌভিক বলেন, ‘ধাতুর একটি ব্লকে খোদাই করে আগে একটা ছবির ছাঁচত তৈরি করে নেওয়া হতো। তারপর ওই ছাঁচে রং লাগিয়ে তার উপর কাগজ চেপে ধরলেই কাগজের গায়ে ছবিটা ফুটে উঠত।’ সংগ্রাহক জানাচ্ছেন, রাজস্থানের কোটা থেকে গহর জানের যে ছবিটি তিনি সংগ্রহ করেছেন, সেই ভঙ্গিতে বিখ্যাত ওই সঙ্গীতশিল্পীর অন্য কোনও ছবি নেই বলেই মনে করা হয়।
সেই আমলে কলকাতা এই রকমের মেটাল ব্লক ছবির জন্য বিখ্যাত ছিল। তাই অনুমান করা যায়, এই ছবিটিও কলকাতাতেই ছাপা। তবে যে ছাঁচ থেকে ওই ছবি তৈরি, সেই ছাঁচের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১০০ বছরের পুরোনো হলেও ওই ছবির অপূর্ব স্নিগ্ধ জেল্লা আজও মুগ্ধ করার মতো। ছবির নীচে ছোট অক্ষরে রোমান হরফে ছাপা রয়েছে ‘মিস গহর’। এ ছাড়াও মূল ছবিটি মন দিয়ে দেখলে বোঝা যায় শিল্পীর শাড়ির নকশা তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে নানা ধরনের ধাতুর গুঁড়ো।
অতি বিরল এই ছবি ছাড়াও এই প্রদর্শনীতে দেখা যাবে পুরোনো আমলের দেশলাই বাক্স, নানা ধরনের টেলিগ্রাফ মেশিন, দোয়াত–কালি–কলম এবং প্রাচীন যুগে ব্যবহার করা নানা ধরনের জন্তুর হাড় ও পাথর দিয়ে তৈরি গয়নার বিচিত্র সংগ্রহও।