এই সময়, মেদিনীপুর: ‘আমার বয়স মাত্র ১৬। কিন্তু, বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে! আমি কি সত্যিই প্রস্তুত? আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। কিন্তু, কী ভাবে বোঝাব সবাইকে?’ আর একজনের প্রশ্ন, ‘আমি একটি ছেলেকে ভালোবাসি। ছেলেটি আমাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আমার পরিবার রাজি হবে না। আমার কী করা উচিত?’
এমনই নানান মানসিক দোটানায় পড়া বা বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়া কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের সঠিক পরামর্শ দিয়ে, তাঁদের মনের জোর ফেরাতে আইআইটি খড়্গপুর ও ‘ইউনাইটেড উই কেয়ার’ নামে একটি সংগঠন যুগ্ম ভাবে তৈরি করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-ভিত্তিক একটি অভিনব অ্যাপ।
বয়ঃসন্ধি বা তারুণ্যের চৌকাঠে পৌঁছনো ছেলেমেয়েদের যে কোনও মানসিক বা শারীরিক সঙ্কটে কাউন্সেলিং ও পরামর্শ দেবে ‘স্টেলা’ নামে এই অ্যাপ। এ ব্যাপারে যাবতীয় গবেষণা ও এই অ্যাপ তৈরির পেছনে মূল কারিগর হলেন আইআইটি খড়্গপুরের বিনোদ গুপ্ত স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক তুতান আহমেদ এবং তাঁর গবেষক ছাত্র সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ‘ইউনাইটেড উই কেয়ার’–এর চিফ টেকনোলজি অফিসার।
এই অ্যাপ তৈরির মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অধ্যাপক আহমেদ শুক্রবার বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি, অনেক কিশোর-কিশোরী সামাজিক ও পারিবারিক চাপে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, যা তাদের ভবিষ্যতের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে। কিন্তু তারা তাদের সমস্যা বা দোটানার কথা কাউকে বলতে পারে না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। এই সমস্যার সমাধান দিতেই আমরা স্টেলা তৈরি করেছি। যেখানে তারা নিজেদের মনের কথা নির্ভয়ে বলতে পারবে এবং এআই-এর সাহায্যে সঠিক পরামর্শ পাবে।’
কী ভাবে কাজ করবে এই বিশেষ পরামর্শদাতা অ্যাপ? ‘ইউনাইটেড উই কেয়ার’-এর সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরে বলেন, ‘আমরা এআই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অ্যাপটি এমন ভাবে ডেভেলপ করেছি, যাতে এটি ব্যবহারকারীদের আবেগ ও তাদের সঙ্কট মুহূর্তেই বিশ্লেষণ করতে পারে। কেউ যদি ‘আমার জীবনের সব আশা শেষ’, এ ধরনের জটিল বা বিপজ্জনক প্রশ্ন করে, তাহলে এই অ্যাপ প্রশ্নটি আত্মহত্যার প্রবণতা হিসেবে শনাক্ত করবে এবং তৎক্ষণাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকটজনদের সতর্ক করার ব্যবস্থা নেবে।’
গবেষকেরা জানিয়েছেন, ‘স্টেলা’ অ্যাপ বাংলা ভাষা বলতে ও বুঝতে পারে। এমনকী, বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক উচ্চারণও এটি শনাক্ত করতে পারে। কেউ ঢাকার বাংলা বললে সেটিও বুঝতে পারবে, আবার কেউ যদি পুরুলিয়ার টানে কথা বলে, সেটাও ধরতে পারবে। ব্যবহারকারীরা বাংলায় কথা বললে এটি রিয়েল টাইমে তা বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া জানাবে। সঙ্কটের মুহূর্তে কেউ যদি গভীর মানসিক চাপে থাকে, তবে এটি তৎক্ষণাৎ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে। অধ্যাপক তুতান আহমেদ আরও জানান, ‘আমরা চেয়েছিলাম এমন একটি প্রযুক্তি তৈরি করতে, যা সত্যিকারের বন্ধু হয়ে উঠবে। বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারবে এবং মানুষের আবেগ বুঝতে পারবে।’
জানা গিয়েছে, ৬০ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল দু’বছর ধরে এই অ্যাপ–টি তৈরি করেছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, মূলত বাল্যবিবাহ আটকানোর কাজে এই অ্যাপ পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক খুরশিদ আলি কাদেরী বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে আইআইটি-র গবেষক দলের সঙ্গে কাজ করছি। এই জেলায় নাবালিকা বিবাহের হার তুলনামূলক ভাবে বেশি। আমরা এই অ্যাপ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার করে দেখছি এবং কোথাও কোনও সমস্যা আসছে কিনা, তাও বিশেষজ্ঞদের জানাচ্ছি।’
বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করে এমন উন্নতমানের ‘এআই কাউন্সেলিং অ্যাপ’ এই প্রথম তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এআই-ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে। অ্যাপটি গুগ্্ল প্লে স্টোর ও অ্যাপ স্টোরে শীঘ্রই প্রকাশিত হবে, যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই এটি ব্যবহার করতে পারেন।