• কলাটা, মুলোটা পেতেই হাতি ফের সাথী, বাঁকুড়ায় গ্রামবাসীদের নিয়ে ‘বড়জোড়া মডেল’ বন দপ্তরের
    এই সময় | ২৮ জানুয়ারি ২০২৫
  • মোহিত দাস, বাঁকুড়া

    শিলাদিত্য সাহা, কলকাতা

    বছর ছয়েক আগের কথা। বাঁকুড়ার বড়জোড়া ব্লকে লোকসভা ভোটের প্রচারে নামা প্রার্থীদের চিন্তা ছিল, হাতির হানায় পরের পর মৃত্যুর ঘটনা প্রভাব ফেলবে না তো ভোটবাক্সে? সরকারি ক্ষতিপূরণ, পরিবারের কাউকে চাকরির আশ্বাস — কোনও পথেই স্থানীয়দের মন পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু তো মৃত্যু নয়, দলমার দাঁতালদের দুলকি চালে অজস্র শস্যখেত, কাঁচা বাড়ি নষ্ট হওয়ার ঘটনা ফি বছর ল‍েগেই ছিল।

    অর্ধ যুগ পার করে সেই বড়জোড়াতেই শীতের সকালে চোখে পড়ছে অন্য দৃশ্য। চাষজমি সংলগ্ন পাবয়া জঙ্গলে বসে রয়েছে দাঁতাল। তার সামনে রাখা প্লাস্টিকের লাল-সাদা গামলায় জল ভরে দিচ্ছেন গ্রামবাসীরা। তৃপ্তিতে সেই জল খেয়ে নিচ্ছে হাতি। কিছুটা দূরে কেউ আবার আখ, কলাগাছ, খড় ছুড়ে দিচ্ছেন জঙ্গলের দিকে। হাতি তা শুঁড়ে পেঁচিয়ে মহানন্দে পুরে দিচ্ছে মুখে। দু’জনের মধ্যে প্রাচীর বলতে শুধু খুঁটিতে বাঁধা বিদ্যুতের ঝটকা দেওয়া তার বা ‘এনার্জাইজ়ড ফেন্স’, যা চাষজমি থেকে দূরে রাখছে জঙ্গলের ‘গণেশবাবা’–দের।

    মানুষ–হাতির সম্পর্কে যখন ‘কনফ্লিক্ট’ তুঙ্গে, তখন বড়জোড়া দেখিয়ে দিচ্ছে, এখনও ‘হাতি মেরে সাথী’র বাস্তব চরিত্রায়ণ সম্ভব। লোকালয় ঘেঁষা জঙ্গল মানেই মানুষ–হাতির শত্রুতা নয়, বিশ্বাসে ভর করে বন্ধুত্বের স্টোরিলাইনও সফল ভাবে এগোতে পারে।

    বন দপ্তর সূত্রে খবর, এই মুহূর্তে বড়জোড়া রেঞ্জ এলাকায় দলমা থেকে আসা ৬১-৬৫টি হাতি রয়েছে। সোমবার সকালে সেখানকার পাবয়া সংলগ্ন ওয়াচ টাওয়ার এবং কালপাইনি শ্মশান এলাকা ঘুরে দেখা গিয়েছে, দু’টি হাতি জঙ্গলের সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এনার্জাইজ়ড ফেন্সের এ পার থেকে দু’জনকে কলা গাছ, আখ, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেল, খড় দিচ্ছেন গ্রামবাসীরা।

    গামলা থেকে জল খেতে অনভ্যস্ত হাতি শুঁড়ের ধাক্কায় সেটা উল্টে ফেললে আবার বাঁকে করে ফেন্সের ফাঁক দিয়ে তাতে জল ঢেলে দিচ্ছেন স্থানীয়রা। কারও মুখে বিরক্তি নেই, আতঙ্কও নেই। বড়জোড়ার পাবয়া, কালপাইনি, ডাকাইসিনি, বনশোল, শ্যামপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, তিন–চার দিন ধরে এই হাতিগুলি একই জায়গায় রয়েছে। ওরা যাতে অভুক্ত না–থাকে, সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছেন গ্রামবাসীরা।

    দলমার হাতির দলই তো গত কয়েক বছরে এই এলাকায় ফসলের ক্ষতি করেছে, বাড়ি ভেঙেছে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। তা হলে কোন জাদুমন্ত্রে সম্ভব হলো এই উলটপুরাণ?

    রাজ্যের মুখ্য বনপাল (দক্ষিণ–পশ্চিম সার্কল) এস কুলান্ডাইভেল জানাচ্ছেন, গ্রামবাসী আর বন দপ্তরের যৌথ প্রচেষ্টাতেই মানুষ–হাতি সংঘাত রোখার এই অভিনব মডেল সাফল্যের মুখ দেখছে। বনকর্তার কথায়, ‘গত তিন বছর ধরে আমরা স্থানীয় বনসুরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে মিলে বড়জোড়া রেঞ্জে এই মডেলটি কার্যকর করেছি। মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই হাতির কোনও ক্ষতি না–করে লোকালয়ে তার ঢুকে পড়া আটকানো।’ কর্তার দাবি, এতে গত তিন বছরে বড়জোড়ায় হাতির হানায় মৃত্যু, শস্যের ক্ষতি, বাড়ি ভাঙার ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। হাতিরা পাবয়া জঙ্গলে বহুদিন থেকে যাচ্ছে। তারা সোনামুখী, গঙ্গাজলঘাঁটি বা বেলিয়াতোড়ের মতো আশপাশের অন্য রেঞ্জে চলে যাচ্ছে না। এতে লোকালয়ে হাতির যাতায়াত বা হানা কমেছে। বড়জোড়ার জঙ্গলের বাইরে শিল্পতালুক এলাকাতেও হাতির হানা অনেক কমানো গিয়েছে। গোটা অঞ্চলে চাষজমি বাঁচাতে ৫৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় এনার্জাইজ়ড ফেন্স বসিয়েছে বন দপ্তর। ওই ফেন্সের সংস্পর্শে এলে হাতি ভয়ে আবার জঙ্গলে সরে যাচ্ছে।

    রোজ হাতির খোরাক জোগাড় হচ্ছে কী ভাবে?

    বন দপ্তর সূত্রে জানা যাচ্ছে, স্থানীয় অর্থনীতিতে যাতে তার সুপ্রভাব পড়ে তার জন্য ‘বড়জোড়া মডেল’ দু’ভাবে কাজ করছে। কুলান্ডাইভেলের কথায়, ‘লোকালয় ঘেঁষা জঙ্গলের ধারে হাতিদের খেতে দেওয়ার কাজের জন্য আমরা দৈনিক মজুরি দিই। তাতে গ্রামের লোকজনের রোজগারের পথ সুগম হয়। ওরা খেতের উদ্বৃত্ত শস্য, আনাজ হাসিমুখেই হাতিদের খেতে দেয়। হাতিরাও সামনে প্রিয় খাবারদাবার পেয়ে ফেন্স ছিঁড়ে শস্যখেতে ঢোকার চেষ্টা করে না। তাতে ফসল নষ্ট হয় না, ভালো দাম পান চাষিরা।’ পাবয়ার বাসিন্দা আভা দিগপতি, নিয়তি মাজি, অসিত মাজিরা জানাচ্ছেন, ওয়াচ টাওয়ার আর কালপাইনি শ্মশান সংলগ্ন এলাকায় চারটি হাতি আছে। কিন্তু তারা লোকালয়ে ঢোকার চেষ্টাও করছে না।

    রাজ্যের এক শীর্ষ বনকর্তার কথায়, ‘জঙ্গলের বুনো হাতিদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। সেখানে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে, হাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে এ ভাবে গত তিন বছরে প্রচুর ক্ষতি রুখেছে বড়জোড়া। মানুষ–হাতি সম্পর্কেও অনেক বদল এসেছে। পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, বন্ধুত্ব তৈরি হচ্ছে, যা আগামী দিনে সংঘাতের সম্ভাবনা কমাচ্ছে।’

  • Link to this news (এই সময়)