• চুরি-ডাকাতির শাস্তি, অভিযুক্তকে গান শোনান ফাঁড়ির ওসি
    এই সময় | ২৮ জানুয়ারি ২০২৫
  • রনি চৌধুরী ■ ধূপগুড়ি

    আসামি ধরে নিয়ে এসেছে পুলিশ। চুরি–ডাকাতি–মারধর–তোলা আদায়, এমন নানা অভিযোগ। সটান লকআপে পুরে ধমক দেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি গান শোনান। গানে গানে জীবনের বার্তা দেন। কখনও মঞ্চে উঠে পড়েন। তখন এই শিল্পী সব দর্শকের, শুধু অপরাধে অভিযুক্তের নন। লোকগীতি তখন মুক্তি পায় খোলা আঙিনায়। এই গানে গানে ফাঁড়ি থেকে মুক্তমঞ্চে নজর কাড়ছেন রমেন লস্কর।

    ডাউকিমারি পুলিশ ফাঁড়ির ওসি রমেন। নিয়মিত দুষ্কৃতীদের ধরে আনেন। লাল চোখে তাদের হুঁশিয়ারি দেওয়ার কথা। কিন্তু তার বদলে রমেন গান শোনান। লোকগীতির বাণীতে জীবনকে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার যে পথ দেখানো আছে, সেটাই তুলে ধরেন আসামিদের সামনে। তারাও মন দিয়ে শোনে, থমকে যায়। এ যেন গুপী–বাঘার গান! সুরে সুরে আসামিদের মন ঘোরানোর চেষ্টা করেন রমেন, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে।

    অথচ গানের কোনও প্রথামাফিক তালিম নেই রমেনের। ছোটবেলায় শুনে শুনে শিখে গিয়েছেন। কী ভাবে? রমেন বলেন, ‘আমাদের চাষাবাদ ছিল। সেই পরিবারের ছেলে আমি। মাঠে চাষ করতাম, হাল ধরতাম। সেই সঙ্গে গানও করতাম। কাজের কষ্ট লাঘব হয়ে যেত, মনটাও ভালো থাকত।’ মাটির ঢেলা ভাঙতে ভাঙতে গাওয়া গান যে রমেনের বুকে মাটির গানের এমন ইমারত গড়ে তুলেছিল, সেটা কে জানত! এখন আনমনে সুর ভাঁজেন, খোলা গলায় গেয়ে মোবাইলে রেকর্ড করে রাখেন।

    সেই গান থানার লকআপ থেকে মুক্তি পেয়ে সাধারণের মধ্যেও পৌঁছে গিয়েছে। এক দিন স্থানীয় একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ডাক পড়েছিল রমেনের। সবাই জানে তাঁর গানের শখের কথা। হঠাৎ উদ্যোক্তারা আব্দার করে বসেন, ‘স্যর একটা গান শোনাতে হবে।’ সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের পক্ষ থেকে রব ওঠে। মঞ্চে উঠে পড়েন রমেন, গেয়ে ফেলেন প্রচলিত লোকগীতি। কখনও গাইছেন— ‘এ জগতে আমি কারও মনের মতো না’, কখনও বা হালকা মুডে ‘হ্যালো হ্যালো মাইওর মাও কন মোবাইল ফোনে’। এ সব শুনে মুগ্ধ এলাকার মানুষজন। তুমুল হাততালির মতো রমেনের গান‍ের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকাতেও।

    রমেন লস্কর প্রথমে ধূপগুড়ি থানার এসআই পদে ছিলেন। গত মে মাসে তাঁকে ডাউকিমারি পুলিশ ফাঁড়ির ওসি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। শখের গান গাইতে গাইতে পুলিশে চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই পেশাদার গায়ক হওয়ার স্বপ্ন অধরা থেকে গিয়েছে তাঁর। সেই আক্ষেপ থাকায় লোকগীতির মরমি ভাষা যেন আরও প্রাণ পাচ্ছে রমেনের কণ্ঠে। স্থানীয় বাসিন্দা সোনালি রায় বলেন, ‘আমরা ভাবতাম, পুলিশ মানে রুক্ষ মেজাজের হবে, বন্দুক হাতে নিয়ে গুন্ডা–বদমায়েশদের ধরবে। কিন্তু এই পুলিশকর্মীকে দেখার পর আমার ধারণা বদলে গিয়েছে। উনি এত সুন্দর গান করেন যে নিজে কানে না শুনলে বোঝা মুশকিল।’ ধূপগুড়ির অপর বাসিন্দা উৎপল রায়ের কথায়, ‘সকলেই ওঁর গান শুনতে ভালোবাসেন। পেশাদার শিল্পীদের মতো গলা। শুনে মনে হবে না যে উনি আদতে একজন পুলিশ আধিকারিক।’

    পুলিশ মহলে রমেনের সহকর্মীরাও একটা সময়ে জানতেন না তাঁর এই প্রতিভার কথা। ধূপগুড়ি থানার আইসি অনিন্দ্য ভট্টাচার্য বলেন, ‘ডাউকিমারি ফাঁড়ির ওসি পুলিশের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সুন্দর গানও গাইতে পারেন। এত সুন্দর গানের গলা ওঁর, এটা আগে জানতাম না। সত্যি তারিফ করার মতো কণ্ঠ।’ অপরাধে অভিযুক্তদের মন গান দিয়ে জয় করার ভাবনাও অভিনব। রমেন বলেন, ‘মানুষের মধ্যে থেকে অপরাধের প্রবণতা বার করে দিতে পারলে সে সৎ পথে চলতে পারে। গানের মধ্যে সেই শক্তি আছে। তাই আমি চেষ্টা করি অভিযুক্তরা গান শোনাতে। আমার আশা, এতে ওদের মন বদল হবে।’

  • Link to this news (এই সময়)