এই সময়: বহুদিনের সাধ ছিল একবার অন্তত মহাকুম্ভের পুণ্যস্নানে অংশ নেবেন। সে জন্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে পাড়ি দিয়েছিলেন বাসন্তী পোদ্দার (৬৫)। মঙ্গলবার রাতে পুণ্যস্নানের জন্য বেরিয়েছিলেন তিনিও। তারপরেই সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা। হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে সেখানে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৩০ জনের। বুধবার রাতে জানা গেল, সেই তালিকায় নাম রয়েছে কলকাতা পুরসভার ৯৫ নম্বর ওয়ার্ডের যাদবপুর–বিজয়গড় লাগোয়া অশ্বিনীনগরের বাসিন্দা বাসন্তীরও।
মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছেছে কলকাতায় তাঁর বাড়িতেও। এ দিন রাতে অশ্বিনীনগরের বাড়িতে যান স্থানীয় কাউন্সিলার তপন দাশগুপ্ত। প্রয়াগরাজ থেকে বাসন্তীর ছেলে সুরজিৎ পোদ্দারও তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এ দিন রাত পর্যন্ত তাঁর মায়ের দেহের ময়নাতদন্ত হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনের কথামতো তাঁরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করছেন। তপন দাশগুপ্ত সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পদপিষ্ট হওয়ার পরে মৃত প্রৌঢ়ার দেহের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। যাতে দ্রুত দেহ সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা যায়, তার জন্য চেষ্টা চলছে।
বাসন্তীর পরিবারের মতো প্রায় একই অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচরাপাড়ার সুমন্ত বিশ্বাস, শিলিগুড়ির দীনেশ পণ্ডিতরা। হুড়োহুড়ির মধ্যে তাঁরাও পালাতে চেয়েছিলেন সোজা পথ ধরে। কিন্তু ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে সুমন্ত দেখেন, তিরবেগে ছুটে আসছে মানুষের ঢেউ। আর ফিরে তাকাননি। ঘণ্টা খানেক পরে জানতে পারেন পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা। সুমন্ত কোনওমতে রক্ষা পেলেও রেহাই পাননি দীনেশ পণ্ডিত। কোনওক্রমে স্নান সারতে পেরেছিলেন তিনি। ঘাট থেকে উঠতেই পিছন থেকে রাম ধাক্কা। তার পরেই সব অন্ধকার। জ্ঞান ফেরে স্বাস্থ্য শিবিরে। আপাতত সুস্থ রয়েছেন দীনেশ।
নদিয়ার নাকাশিপাড়ার ত্রিদেব রায় গিয়েছিলেন পরিবার নিয়ে। বাকিরা রাতে না–বেরলেও তিনি সঙ্গমে স্নান করতে গিয়ে গোলমালের মধ্যে পড়ে পায়ে চোট পান। পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে একটি শিবিরে রেখেছিল। বিস্তর খোঁজাখুজির পরে বুধবার দুপুরে পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পেয়েছেন। ত্রিদেবের কথায়, ‘আমি কিছুটা দেরি করেই গিয়েছিলাম। মাঝ রাস্তায় পৌঁছেই দেখি প্রবল চিৎকার চেঁচামেচি এবং হুড়োহুড়ি চলছে। পুলিশ লাঠি নিয়ে তাড়া করেছে। আমি পালানোর চেষ্টা করতেই পড়ে যাই। আমার পায়ের উপর দিয়ে দু’জন চলে যান। এক জন হাত ধরে টেনে ভিড়ের বাইরে নিয়ে যান। সেখান থেকে হাসপাতালে। চোট গুরুতর নয় বলে ঘণ্টা চারেক পরে ছেড়ে দিয়েছে।’
সঙ্গীদের কাছে পরনের পোশাক–টাকা–মোবাইল রেখে বুধবার ভোর তিনটেয় মহাকুম্ভে স্নান করতে নেমেছিলেন নদিয়ার ধানতলার বঙ্কিমনগর গ্রামের গোপীনাথ দত্ত। ডুব দিয়ে উঠে সঙ্গীদের কাউকে খুঁজে না–পেয়ে শেষপর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা গামছা পরেই ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রয়াগরাজে। এ দিকে ছেলের সঙ্গীদের কাছ থেকে ফোন পান গোপীনাথের বাবা। ছেলে নিখোঁজ জেনে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে পরিবারে।
সরকারি হেল্পলাইন নম্বরে যোগাযোগও করেন তাঁরা। দুপুরে অন্য এক তীর্থযাত্রীর মোবাইল থেকে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করেন গোপীনাথ। তাঁর মেয়ে গীতশ্রী বলেন, ‘অনেক ঘোরাঘুরির পরে এক জন বাবাকে পরার কাপড় আর একশো টাকা দিয়েছেন। তবে সঙ্গীদের সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি তাঁর। ওখানকার রেলপুলিশ আশ্বাস দিয়েছে, বাবাকে ফেরার ট্রেনে তুলে দেওয়া হবে।’
বীরভূমের সুকুমার ভট্টাচার্য উঠেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের আখড়ায়। তিনি বলেন, ‘পুলের মাঝামাঝি যাওয়ার পরে খবর আসে, প্রবল ভিড়ের জন্য স্নান আপাতত বন্ধ। দেখি উল্টো দিক থেকে প্রচুর মানুষ আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। আমরা ফিরতে শুরু করি। ভিড়ের চাপে অনেকে পড়ে যান। কিছু লোক বাঁশের ব্যারিকেড টপকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। রাস্তাতেও প্রচুর মানুষ শুয়েছিলেন। চোখের সামনে তাঁদের পদপিষ্ট হতে দেখেছি।’