• বই পড়া না বই শোনা? দ্বন্দ্ব খুঁজতে আলোচনা
    এই সময় | ৩০ জানুয়ারি ২০২৫
  • বাঙালি বই পড়ছে? না, বই শুনছে? ইউটিউব, ফেসবুকের দর্পের যুগেও টিকে আছে ছোট–বড় বইমেলা। সেখানে কাতারে কাতারে মানুষ বইও কিনছেন। কিন্তু সেই বই কি সত্যিই মানুষ পড়ছেন? না সাহিত্য–প্রেমী বাঙালি এখন পাঠক থেকে শ্রোতায় পরিণত হয়েছে? বই পড়তে গেলে যে ধৈর্য, অধ্যাবসায় এবং একাগ্রতার দরকার, নিউ এজ পাঠকের কি সেই সময় আছে? নাকি সেই পাঠক বহু দিনই হলো নতুন বইয়ের আঘ্রাণ নেওয়া ছেড়ে গোগ্রাসে শুনছে ইউটিউব অডিয়ো স্টোরি? এই মোক্ষম প্রশ্ন নিয়েই ৪৮ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা প্রাঙ্গণ থেকে পথচলা শুরু করল ‘এই সময় প্যাভিলিয়ন’–এর ‘এই সময় প্রাইম’ আলোচনাসভা। প্রথম দিনের এই আলোচনায় যুক্ত হয়েছিলেন দুই কৃতী বাঙালি। একজন স্টোরি টেলার তথা প্রাক্তন আরজে দীপাঞ্জন ঘোষ বা দীপ, অন্যজন সাহিত্যিক হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত।

    ২০০৮-০৯ সালে বাঙালিকে প্রথম অডিয়ো বুক শুনিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম দীপ। কিন্তু ১৭ বছরের এই দীর্ঘ যাত্রা শেষে কি দীপের মনে হয় তাঁরা বাঙালিকে অডিয়ো স্টোরি শোনাতে গিয়ে বই পড়ার অভ্যেস বা রিডিং হ্যাবিটটাই নষ্ট করে দিয়েছেন? দীপ সহমত নন— ‘বহু লেখককে পরিচিতি দিয়েছে আমাদের তৈরি অডিয়ো স্টোরি। প্রচুর খ্যাতনামা এবং ততটা খ্যাতি নেই এমন প্রকাশকের বিক্রিও বেড়েছে। কোনও লেখকের একটা গল্প হয়তো অডিয়ো ফর্ম্যাটে মানুষের ভালো লেগেছে। তাই পরে সেই লেখকের বই অনেকে কিনেছেন।’

    লেখক হিসেবে হিমাদ্রিকিশোর সাহসী মানুষ। লিখবেন বলেই সরকারি চাকরি ছেড়েছেন। হার্ড কভারে যেমন তিনি জনপ্রিয়, তেমনই পুপলার ইউটিউবের বিভিন্ন অডিয়ো স্টোরি চ্যানেলেও। দুই ফর্ম্যাটে পার্থক্য প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমার মনে হয় না কোনও পার্থক্য আছে। অডিয়ো বুকের জন্য লেখা আর কাগজে–কলমের লেখার মধ্যে সেই অর্থে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। তবে এ কথা ঠিক যে, এখন বহু লেখকই শুধু ছাপানোর জন্য লেখেন না। অডিয়ো বুকের বিষয়টিও তাঁদের মাথায় থাকে।’ অতএব, পাঠক এবং লেখক— দু’পক্ষেই যে একটা পরিবর্তন এসেছে, তা নিয়ে সংশয় নেই।

    কিন্তু ক্রাইসিস কি শুধু রিডিং হ্যাবিটেই আটকে? অডিয়ো বুকের কি ক্রাইসিস নেই? অনেকে বলেন, অডিয়ো বুকগুলো স্লিপিং পিলের মতো। অর্থাৎ, ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিয়ম করে অডিয়ো বুক চালিয়ে শ্রোতা ঘুমিয়ে পড়ছেন। তাই গল্প আর শোনাই হচ্ছে না। এ কথা শুনে দীপ হাসছেন। জানাচ্ছেন, এই অভ্যেস যে তাঁরও রয়েছে! অবশ্য এ–ও বলছেন, ‘অডিয়ো বুক বলতে ক্লাসিক্যালি যেটা বোঝায়, সেটা শোনার মতো মানসিকতা ভারতীয় শ্রোতাদের হয়নি। বিদেশে অডিয়ো বুক মানে কিন্তু আমাদের এখানকার মতো নাটক বা সাউন্ড এফেক্ট নয়। ওখানে অডিয়ো বুক পড়েন একজনই। কোনও এফেক্ট নেই, অভিনয় নেই। আমরা কিন্তু মূলত বেতার নাটকের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি।’

    তাই পাঠককে আরও সচেতন হবে বলে মনে করেন দীপ। হিমাদ্রিকিশোর মনে করেন, গল্প আর অডিয়ো বুকের সম্পর্কটা অনেকটা ক্ষার ও ক্ষারকের মতো। সব অডিয়ো বুক সাহিত্য হতে বাধ্য, কিন্তু সব সাহিত্য অডিয়ো বুক হতে পারবে না। হিমাদ্রিকিশোরের কথায়, ‘ইবন বতুতার ‘ভ্রমণ কাহিনী’ বা কার্ল মার্কসের ‘ডস ক্যাপিটল’ কখনওই অডিয়ো বুক হতে পারবে না। কারণ এই ফর্ম্যাট এখনও বিনোদনমূলক।’ ফলে বই পড়ার সঙ্গে শোনার দ্বন্দ্ব যে একেবারে নেই, তেমন নয়। যাঁরা সিরিয়াসলি পড়তে চান, তাঁদের জন্য যে সাহিত্য ভাণ্ডার রয়েছে, সেই বিপুল অপশন অডিয়ো বুকের ক্ষেত্রে নেই। আর এটা থাকবে বলেই মনে করেন দুই বিশেষজ্ঞ।

  • Link to this news (এই সময়)