• ‘সোনার খনি’ বেআইনি প্রোমোটিং, লাগাম পরাতে রুখে দাঁড়াবে কে?
    এই সময় | ৩০ জানুয়ারি ২০২৫
  • তাপস প্রামাণিক ও দেবাশিস দাস

    কলকাতায় কম সময়ে বড়লোক হওয়ার সহজ পথ কী? পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে প্রাক্তন পুলিশকর্তা —সবাই একবাক্যে জানাচ্ছেন, ‘সোনার খনি’ বেআইনি প্রোমোটিংই। এই ব্যবসায় লাভের অঙ্ক সব থেকে বেশি। বিনিয়োগ করলে রাতারাতি বড়লোক হওয়া এক রকম নিশ্চিত। সেই লোভে কলকাতা এবং সন্নিহিত এলাকায় আরও বেশি বেশি করে লোকজন বেআইনি প্রোমোটিংয়ে জড়াচ্ছেন। পুরোনো সমাজবিরোধী থেকে নেতা–মন্ত্রী, বড় ব্যবসায়ী, পুলিশ আধিকারিক, সরকারি আমলা —বিভিন্ন জগতের মানুষ টাকা ঢালছেন এই কারবারে।

    পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের এক আধিকারিকের ব্যাখ্যা, বেআইনি বাড়ি নির্মাণে পুরসভাকে ফি দেওয়ার বালাই নেই। ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা এফএআর–এর ক্ষেত্রেও কোনও নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে বাড়ি বানাতে খুব বেশি জায়গা ছাড়তেও হয় না। ফ্লোরের সংখ্যা বাড়াতেও সমস্যা নেই। তাই আইনি বাড়ির তুলনায় বেআইনি ফ্ল্যাটে বেশি স্পেস বিক্রি করতে পারেন প্রোমোটাররা। লাভের অঙ্কও বেশি হয়। ওই আধিকারিকের কথায়, ‘কলকাতায় এমন কোনও ব্যবসা নেই যা বেআইনি প্রোমোটিংয়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। রোজগারের দিক থেকে শহরে এটাই সবচেয়ে লুক্রেটিভ বিজনেস।’

    বয়স ৪০। বাড়ি টালিগঞ্জের অশ্বিনীনগরে। কয়েক বছর আগেও নিজের বাড়িটা নড়বড়ে ছিল। দু’বেলা খাবার নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা। চা–দোকানেও ধারবাকি পড়েছিল। কিন্তু বেআইনি প্রোমোটিংয়ের সুবাদে কয়েক বছরের মধ্যে সেই তিনিই এখন হোমরাচোমরা ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন। পুজো হোক বা ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অকাতরে টাকা ঢালেন।

    পুরসভার ইঞ্জিনিয়ার, থানার অফিসার এবং এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা। বেআইনি প্রোমোটিংয়ে তিনি এর মধ্যেই রেকর্ড গড়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, এ পর্যন্ত ‘দাদা’ প্রায় ৭০টি বেআইনি বাড়ি তৈরি করেছেন। তার মধ্যে কয়েকটা বাড়ি ভাঙাও পড়েছে। এ নিয়ে অবশ্য তাঁর কোনও তাপ–উত্তাপ নেই। তাঁর কথায়, ‘বেআইনি বাড়ি বানাতে গেলে দু’একটা ভাঙা পড়তেই পারে। এটা ধরে নিয়েই ব্যবসা করতে হয়।’

    পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের আধিকারিকরা বেআইনি প্রোমোটিংয়ে লাভের যে অঙ্ক শোনাচ্ছেন, সেটা জানলে বড় বড় শিল্পসংস্থার কর্তাদেরও হয়তো চোখ কপালে উঠবে। টালিগঞ্জ, যাদবপুর অঞ্চলে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বেআইনি ফ্ল্যাট নির্মাণ করছেন, সেই সব প্রোমোটার এবং ডেভলপারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, কলোনি অঞ্চলে একটা বেআইনি ফ্ল্যাট বানাতে প্রতি বর্গফুটে গড়ে ১৬০০–১৭০০ টাকা খরচ। আর সেটা বিক্রি হয় প্রতি বর্গফুট ২৮০০–৪০০০ টাকা দরে। যদি জমির আয়তন তিন কাঠা হয় এবং তার উপরে চারতলা বাড়ি বানানো যায় তা হলে গড়ে ১০–১২টা ফ্ল্যাট তৈরি করা সম্ভব।

    বিনিয়োগ মোটামুটি ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা। আর ১২টা ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারলে লাভ থাকে ৩০–৩২ লক্ষ টাকা। যাদবপুর অঞ্চলের এক প্রোমোটারের কথায়, ‘একটা বেআইনি ফ্ল্যাট তৈরি করতে নেতা, পুলিশ, পুরসভার অফিসার, স্থানীয় ক্লাবকে খুশি রাখতে হয়। রক্তদান শিবির, পুজো, খেলায় চাঁদা দিতে হয়। এ জন্যে গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা বেরিয়ে যায়। তা না হলে এই ব্যবসা করা যায় না।’

    সদ্য চাকরি থেকে অবসর নেওয়া রাজ্য পুলিশের এক কর্তার অনুমান, কলকাতায় বেআইনি প্রোমোটিংয়ে বছরে কম করে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়। তার সিংহভাগটাই হিসাব–বহির্ভূত টাকা। তাঁর ব্যাখ্যা, বেআইনি প্রোমোটিং ব্যবসায় নগদ টাকা বিনিয়োগের সুযোগ বেশি। ইট, বালি, সিমেন্ট, লোহার রড কেনা, শ্রমিকদের মজুরি সবটাই নগদে পেমেন্ট করা যায়। বেআইনি প্রোমোটিংয়ের আর একটা সুবিধা হলো, যি‍নি টাকা ঢালছেন তাঁর নাম কাগজকলমে কোথাও থাকে না। ফলে ধরা পড়লে হয় জমির মালিক নয় তো গরিব শ্রমিকদের নামে থানায় এফআইআর রুজু হয়। প্রোমোটাররা রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরেই!

  • Link to this news (এই সময়)