• ‘পুলিশ ক্যালাস’, জোড়ামৃত্যুতে ভর্ৎসনা
    এই সময় | ৩০ জানুয়ারি ২০২৫
  • এই সময়: শিলিগুড়ির কাছে ভক্তিনগর এলাকায় বছর খানেক আগে একটি ফ্ল্যাটে মা-মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় মা আত্মহত্যা করেছেন এবং তাঁর মেয়েকে খুন করা হয়েছে বলে ময়না–তদন্ত রিপোর্টে ইঙ্গিত মেলে। জোড়া অপমৃত্যুর ওই ঘটনার পুলিশি তদন্তে বিস্তর ত্রুটি আছে বলে জানিয়ে বুধবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কলকাতা হাইকোর্টের জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চ।

    এ দিন বিচারপতি জয়মাল্য বাগচি ও বিচারপতি গৌরাঙ্গ কান্তের ডিভিশন বেঞ্চের প্রশ্ন, যেখানে জমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আবার মেয়ের সঙ্গে যে মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁর স্বামীর ভূমিকাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, সেখানে তদন্তে পুলিশ এমন নির্লিপ্ত মনোভাব কী ভাবে দেখায়? ক্ষুব্ধ ডিভিশন বেঞ্চের মন্তব্য, ‘পুলিশের ক্যালাস অফিসারদের জন্য দু’টো মানুষের মৃত্যুর কিনারা এতদিনেও হলো না।’

    শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার সি সুধাকরকে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, সিপি নিজেকে মাথায় রেখে সাইবার–সহ বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সিট গঠন করবেন। হাইকোর্টের নজরদারিতে তদন্ত চলবে। তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট ১৫ দিন অন্তর দিতে হবে হাইকোর্টে।

    ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর শিলিগুড়ি কমিশনারেটের ভক্তিনগর থানা এলাকার একটি আবাসনের ফ্ল্যাটের দু’টি ঘরে পাওয়া যায় লতা সরকার ও তাঁর মেয়ে তিয়াসা সরকারের মৃতদেহ। ময়না–তদন্ত রিপোর্টে জানানো হয়, তিয়াসার মাথার পিছনে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করার ফলে প্রবল রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আর লতা বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন বলে ইঙ্গিত মেলে ময়না–তদন্ত রিপোর্টে। লতার দেহের পাশ থেকে পুলিশ একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করে।

    একটি জমি কেনা নিয়ে স্থানীয় কিছু জমি মাফিয়া তাঁকে ও পেশায় প্রোমোটার তাঁর স্বামীকে প্রাণে মারার হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। ওই মাফিয়াদের ক্রমাগত হুমকির চাপ নিতে না–পারায় তিনি আত্মহত্যা করছেন লতা তাঁর সুইসাইড নোটে জানান। কিন্তু সেই নোটে তিনি তাঁর অবর্তমানে মেয়ে তিয়াসার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য নিজের বোন ও ভগ্নীপতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। যদিও তদন্তে পুলিশ দাবি করে, মেয়ে তিয়াসাকে খুন করে লতা সরকার আত্মঘাতী হয়েছেন।

    ওই ঘটনায় অভিযুক্ত দুই প্রোমোটারের একজন আগাম জামিন পেয়েছিলেন। আর এক জন প্রোমোটার গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়া প্রোমোটার এ দিন জামিনের জন্য আবেদন করলে সার্কিট বেঞ্চে এই শুনানি শুরু হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত ওই প্রোমোটারের জামিনের আবেদন খারিজ করেছে হাইকোর্ট।

    এ দিন ওই মামলার যাবতীয় নথি দেখে বিচারপতি বাগচির প্রশ্ন, ‘মা যদি সুইসাইড নোটে মেয়ের সুরক্ষার জন্য আত্মীয়দের নাম লিখে যান, তা হলে মেয়েকে তিনি খুন করেছেন, এই যুক্তি কী ভাবে দেওয়া যায়? আবার মেয়ের দেহ যে ঘরে পাওয়া গিয়েছে, সেই ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। সেটা কী করে সম্ভব! মৃত লতার স্বামী সাক্ষ্যে জানান, ঘটনার দিন সকালে তিনি প্রোমোটিংয়ের সাইটে গিয়েছিলেন। তবে সে কথা কি ক্রসচেক করে দেখেছেন তদন্তকারী অফিসার?’ বিচারপতি বাগচির আরও প্রশ্ন, ‘যদি মেয়েকে খুন করা হয়ে থাকে, তা হলে কী দিয়ে খুন করা হয়েছে? সেই অস্ত্র কেন এতদিনেও উদ্ধার করা হলো না?’

    পুলিশি তদন্তে একের পর এক ত্রুটি নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে করতে এক সময়ে কটাক্ষের সুরে বিচারপতি বাগচি বলেন, ‘আসলে এই ঘটনায় এক অভিযুক্তকে কোর্ট আগাম জামিন দিয়েছে, ফলে তাঁর আইনজীবীরা খুশি, খুশি পাব‍লিক প্রসিকিউটরও। তবে অভিযুক্তর আগাম জামিন হয়ে যাওয়ায় সব চেয়ে খুশি পুলিশ। সবাই খুশি, সবাই সন্তুষ্ট। শুধু তদন্তটাই হয়নি। কেউ সত্যের কাছে যেতে চাইছেন না। সমস্যা এটাই।’

    এর আগেও এই মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তকারী অফিসার পরিবর্তন করা হয়। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পুলিশের উদ্দেশে বিচারপতি বাগচির তির্যক মন্তব্য, ‘আপনাদের এসিপি–কে বলুন, এটা অফিসে বসে করার তদন্ত নয়। ফিল্ডে গিয়ে এই তদন্ত করতে হয়।’ আদালতের বক্তব্য, ফরেন্সিক পরীক্ষায় সুইসাইড নোট যে লতারই লেখা, সেটা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই সুইসাইড নোট নিয়ে পুলিশ আর কিছু ভাবেনি, একটা সিদ্ধান্তে শুধু পৌঁছে যেতে চেয়েছে। আদালতের স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ, ‘আসলে সবাই, এমনকী পুলিশও একটা খুনকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

  • Link to this news (এই সময়)