এই সময়: একের পর এক ঘটনা, আর প্রতিটি ঘটনায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও যেন উচ্চ লয়ে বাধা। কোথাও পাবলিক শেমিং, কোথাও মারধর–হেনস্থা, এমনকী সবার সামনে জুতো দিয়ে মারার ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। শহর কলকাতায় প্রকাশ্যে আলিঙ্গনরত বা চুম্বনরত যুগলকে দেখে জনতার এই মারমুখী নীতিপুলিশি নিয়ে চিন্তিত নাগরিক সমাজের অনেকে।
মাস খানেক আগে কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে চুম্বনরত এক যুগলের ভিডিয়ো তাঁদের অনুমতি না–নিয়েই রেকর্ড করা হয় এবং তা ভাইরাল করা হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না–কাটতেই বুধবার রাতে কবি সুভাষগামী মেট্রোয় এক কাপল ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ছিলেন, এই ‘অপরাধে’ তাঁদের জুতো দিয়ে মারা হয় ট্রেনের ভিতরেই। প্রতিরোধ করলে জোটে আরও মার!
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কেন এ ভাবে মারমুখী হয়ে উঠছে জনতা? কেনই বা প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিক্টিম কাপলরা আর প্রকাশ্যে এসে কোনও অভিযোগ দায়ের করার সাহস দেখাচ্ছেন না? এই দ্বন্দ্বের শেষ কোথায় ও কী ভাবে, তার সদুত্তর পাওয়া কঠিন বলেই মনে করছে নাগরিক সমাজ। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে একটি গানে নচিকেতা চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া এই দেশে অপরাধ, ঘুষ খাওয়া কখনওই নয়!’ কিন্তু তার পর তো তিন দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেল। এখন একবিংশ শতক।
এখনও কি কলকাতা শহর প্রোগ্রেসিভ হতে পারছে না? এখন প্রবীণ নচিকেতা হাসেন। তিনি বলছেন, ‘আরে বাবা, এই শহরে প্রগতিশীল মানুষরা সব সময়েই সংখ্যালঘু। রাজনীতির কারবারিরা কখনওই চান না, শহরটা প্রোগ্রেসিভ হোক! চুমু খেতে দেখা ছেলেমেয়েদের দেখে অতৃপ্ত যৌনতায় ভোগা মানুষের এমন ফিউরিয়াস হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। যৌন ঈর্ষায় ভোগা কতগুলো পাবলিকের জন্য এই সব হচ্ছে।’
কালীঘাট, টালিগঞ্জের সাম্প্রতিক ঘটনার আগেও মেট্রোয় এই ধরনের ঘটনায় নীতিপুলিশি এবং মারধরের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৮ সালে দমদম স্টেশনে এক চুম্বনরত যুগলকে মারধর করার বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে ওঠে শহর। তবে শুধু মেট্রোতেই নয়, বছর দেড়েক আগে ঐতিহাসিক ভাবে প্রগতিশীল ক্যাম্পাস বলে পরিচিত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ তোলেন, সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরে রাখা তাঁদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ফুটেজ পেন ড্রাইভে সেভ করে রেখে কর্তৃপক্ষ সেটা অভিভাবকদের দেখিয়েছেন!
দিন কয়েক আগেই মৌলানা আবুল কালাম আজ়াদ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হরিণঘাটা ক্যাম্পাসে হস্টেলের সামনে এক ছাত্র ও ছাত্রীকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পেয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা বেধড়ক মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে সল্টলেকেও পার্কের মধ্যে চুমু খাওয়ার ‘অপরাধে’ হেনস্থা হতে হয়েছে কয়েক জনকে।
সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদারের বক্তব্য, ‘এ তো তারুণ্যের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি! ইন্টারনেটের এই বিস্ফোরণের যুগে ইয়ং ছেলেমেয়েরা বিশ্বের সঙ্গে কানেক্টেড। পশ্চিমি সভ্যতার খোলামেলা ভাব তাঁদের উপরে প্রভাব ফেলছে। ফলে, প্রকাশ্যে চুম্বন করতে অনেকেই আর হেজ়িটেট করছেন না।’ কিন্তু সেই চুমু দেখে মানুষের মধ্যে ভালোবাসার বদলে হিংসার উদ্রেক হচ্ছে কেন?’
অভিযোগ, বুধবার রাতে কবি সুভাষগামী মেট্ট্রোয় ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকা ওই কাপলকে হেনস্থা করার সময়ে এক প্রবীণ যাত্রী বলেন, ‘এটা ভারত। ইউরোপ, আমেরিকা নয়! এখানে এ সব চলবে না।’ তিলোত্তমার ব্যাখ্যা, ‘যৌনতা নিয়ে বঙ্গ সমাজে যে রক্ষণশীলতা রয়েছে, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ! এখনও আমাদের সমাজ এই প্রকাশ্য চুম্বনের জন্য রেডি নয়!’
অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত অবশ্য প্রকাশ্যে চুম্বনের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন না। তিনি বলছেন, ‘আমি অনেক ছোটেবেলা থেকে দেখেছি, নন্দনের পিছনে বাগানে বা বিভিন্ন পিকনিক স্পটে কত কত কাপল ঘনিষ্ঠ অবস্থায় বসে রয়েছেন। বাড়ির বড়রা তা নিয়ে নিন্দে–মন্দ অবশ্যই করেছেন, কিন্তু ওদের মারতে যাননি কখনও। যাঁরা এই নীতিপুলিশি চালাচ্ছেন, তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, রাস্তায় থুথু ফেলা, মূত্রত্যাগ করা, মহিলাদের অসম্মান করার সময়ে এই জুতো মারার সাহস কোথায় যায়?’
এই পরিস্থিতিতে গায়ক–অভিনেতা শিলাজিৎ কিন্তু শঙ্কিত। তাঁর কথায়, ‘আজকের সোসাইটিতে অসহিষ্ণুতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে আমার চিন্তা হয়, যদি রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের জমানায় আমি জন্মাতাম আর এই অসহিষ্ণু জনতা যদি সেখানে এই ভাবে থাকত, তা হলে আমি সতীদাহ প্রথার বিলোপ কিংবা বিধবা বিবাহ চালু করার পক্ষে দাঁড়াতে পারতাম কি না।’
আইন বলছে, এ দেশে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া অপরাধ নয়, যতক্ষণ না তা কোনও তৃতীয় ব্যক্তির সরাসরি অসুবিধে তৈরি করছে। বরং, যাঁরা চুমু খাচ্ছেন, তাঁদের দু’জনেরই সম্মতি রয়েছে কি না, সেটাই সব চেয়ে বড় কথা। তা হলে লাঞ্ছিত যুগলরা কখনওই প্রকাশ্যে আসেন না কেন? কেন তাঁদের সাহস আচমকা শেষ হয়ে যায়?
অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ‘প্রকাশ্যে চুমু খাওয়াটা ব্যক্তিগত চয়েস। কিন্তু প্রকাশ্যে এসে মুখ খোলাটা ব্যক্তিগত চয়েসের উপরে সব সময়ে নির্ভর করতে না–ও পারে। কারণ, পারিবারিক চাপ বলে একটা বিষয় তো আছে।’ দেবলীনা মনে করেন, ‘যাঁরা ভিক্টিম, তাঁদের বেশির ভাগেরই বয়স কম। তাঁরা সব দিক থেকে পরিবারের উপরে নির্ভরশীল। পরিবারের মধ্যেই তাঁরা জুতো খাচ্ছেন না তো? এই খবরও কিন্তু আমাদের নিতে হবে।’