• মৃত্যু-মুখ থেকে বেঁচে ফিরছি এটাই যেন অনেক, মহাকুম্ভের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বাণীকণার
    এই সময় | ৩১ জানুয়ারি ২০২৫
  • বাণীকণা পাল

    অনেক দিন ধরেই খুব ইচ্ছে ছিল মহাকুম্ভ দেখার। কিন্তু গিয়ে এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হলো যা আজীবন ভুলব না।

    সেখানে কি একা বা দু’একজনে গিয়ে পোষায়? তাই দুই পরিবারের আট জনে মিলে যাওয়ার পরিকল্পনা হলো। আমি ও আমার স্বামী থাকি মেদিনীপুরে। সঙ্গে ছিলেন আমার ননদ-নন্দাই ও ননদের শাশুড়ি। ওঁদের বাড়ি শালবনীতে। আরও তিন জন ছিলেন। গত সোমবার খড়্গপুর থেকে ট্রেন ধরি। টিকিট ছিল সাঁতরাগাছি-আনন্দ বিহার সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনের। সকালের ট্রেন এল সন্ধেয়।

    তবে জীবনে প্রথম বার প্রয়াগরাজে যাওয়ার আনন্দে স্বাভাবিক ভাবেই এ সব দেরিতে আমার কিছু যায় আসেনি। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ ট্রেন থেকে নেমে প্রায় ছ'কিলোমিটার হেঁটে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অতিথিশালায় পৌঁছলাম। সেখানে খাওয়াদাওয়া সেরে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। রাতে পুণ্যস্নান। তাই খাওয়াদাওয়া সেরে একসঙ্গে সবাই বেরোলাম রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ। মেলা তো নয়! লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে জায়গাটা দেখে সম্ভ্রম জাগল, কিছুটা ভয়ও লাগছিল ভিড়ের বহর দেখে। তবু আমরা এক সঙ্গেই আস্তে আস্তে ত্রিবেণী সঙ্গমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম মহাস্নানের জন্য।

    রাত তখন একটা-দেড়টা হবে। চার দিকে কেমন যেন হুড়োহুড়ি। চিৎকারও। ভিড় বাড়তে বাড়তে যেন ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছে। সবাই বিভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক করতে গিয়ে কখন যেন ছিটকে গেলাম একে অন্যের থেকে। কেউ কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। তবু নিশ্চিন্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম, ভিড়ে সবাই এদিক ওদিক হয়ে গিয়েছে। ঠিক খুঁজে পাব। আমি একাই আমার মতো করে স্নান সেরে বাকিদের ফোনে ধরার চেষ্টা করছি। তখন কান্নার শব্দ এল কানে! অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেনও ঘনঘন শোনা যাচ্ছে।

    এ বার আতঙ্ক শুরু আমার। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি সবাইকে। কিন্তু এদিক থেকে ওদিক কোথাও যেতে দিচ্ছে না পুলিশ। সব দিকেই আটকে দিচ্ছে। ততক্ষণে রাত পেরিয়ে আকাশ লাল হয়েছে সবে। হঠাৎ আমাদের এক সঙ্গীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হলো। বাকিদের কাউকে পাইনি তখনও। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। শুনলাম অনেকে মারা গিয়েছেন ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে! অনেকে জখম, অনেককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সব শুনে সত্যি খুব ভয় লাগছিল।

    দুপুর পর্যন্ত অন্যদের খুঁজে পাওয়া গেলেও মাসিমা অর্থাৎ ননদের শাশুড়ির (ঊর্মিলা ভুঁইয়া) তখনও খোঁজ মেলেনি। ইতিমধ্যে জানতে পারি, মৌমিতা মাহাতো নামে আমাদের এক সঙ্গীর পায়ে চোট লেগেছে। কিছুক্ষণ পরে শুনলাম, মাসিমাকে নাকি পাওয়া গিয়েছে স্থানীয় এক হাসপাতালে। শুনলাম, উনি মারা গিয়েছেন, ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে। তখন মনের যে কী অবস্থা, কী বলব! চেষ্টা করেও হাসপাতালে যেতে পারিনি ভিড়ের ঠেলায়। কোনও রকমে একটা রাস্তা দিয়ে বেরোলাম। একাই। সেটা স্টেশন যাওয়ার রাস্তা।

    জানতাম, বুধবার রাতেই আমাদের ফেরার ট্রেনের টিকিট ছিল। বাকিরা শুনলাম, মাসিমার মৃতদেহ নিয়ে ফিরছেন অ্যাম্বুল্যান্সে। আমি অগত্যা একাই ট্রেন ধরলাম। ট্রেনেও প্রচণ্ড ভিড়। কোনও রকমে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরছি, এই অনেক।

    তবে মহাকুম্ভে গিয়ে দেখলাম, ওখানকার সরকার যা–ই বলুক, চরম অব্যবস্থা মেলা জুড়ে। পুলিশ, প্রশাসনের লোকজন, স্বেচ্ছাসেবক কেউ সহযোগিতাও করছে না বিপদের সময়ে। যে যাঁর নিজের মতো করে যাচ্ছেন। তবে এই শেষ! আর কোনও দিন কুম্ভে যাব না। আর কাউকে যেতেও উৎসাহ দেবো না।

  • Link to this news (এই সময়)