আপনার বহুতলটিও হেলে পড়তে পারে কি? আগে থেকেই বুঝবেন কী করে?
হিন্দুস্তান টাইমস | ৩১ জানুয়ারি ২০২৫
কলকাতা ও শহরতলিতে একের পর এক বহুতল হেলে পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। আমাদের বাড়িটাও হেলে পড়বে না তো? এই আশঙ্কায় চোখের ঘুম উড়েছে অনেকের। কেন বহুতল হেলে পড়ছে তা নিয়ে চলছে রাজনৈতিক দায় ঠেলাঠেলির খেলাও। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনার পিছনে রয়েছে রাজনীতি ও অর্থনীতির মিশেল। যার জেরে আইন কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তৈরি হচ্ছে একের পর এক তলা। আর চোখে ঠুলি পরে রয়েছে সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা।
বাঘাযতীনে বহুতল হেলে পড়ার ঘটনার পর গত ২ সপ্তাহে কলকাতা ও শহরতলিতে রোজই হেলে পড়া নতুন নতুন ভবনের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। লক্ষ্যনীয়ভাবে বহুতলগুলির প্রায় প্রতিটিই কলোনি বা বস্তি এলাকায়। প্রায় প্রতিটি বাড়িই তৈরি হয়েছে জলা জমি ভর্তি করে। যেখানে বহুতল বানানোই নিষিদ্ধ। এছাড়া প্রতিটি বহুতলই হেলে পড়েছে ঠিক তার লাগোয়া একটি বাড়ির দিকে বা বাড়ির ওপরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত ২টি কারণে বহুতল হেলে পড়ার প্রবণতা। প্রথমত কলোনি ও বস্তি এলাকায় বিল্ডিং প্ল্যানের কোনও হিসেব নিকেশ থাকে না। বিল্ডিংয়ের চারিদিকে কতটা জমি ছাড়া হল তার পরোয়া করে না কেউ। সবাই নিয়ম ভেঙে যতটা বেশি জায়গাজুড়ে বাড়ি করা যায় তার চেষ্টা করে। কেউই নিয়মের পরোয়া করে না বলে কোনও অভিযোগও জমা পড়ে না। আর অভিযোগ জমা পড়ে না বলে তৎপরতাও দেখায় না পুরসভা। কিন্তু ঘেঁষাঘেঁষি করে বহুতল তৈরির ফলে বহুতলের যে চাপ তা সঠিক ভাবে মাটির মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। বৈশিষ্ট্য অনুসারে প্রত্যেক এলাকার মাটির চাপ সহ্য করার একটা সর্বোচ্চ ক্ষমতা আছে। গাঙ্গেয় বদ্বীপ ও লাগোয়া এলাকার পলিমাটির চাপ সহ্য করার ক্ষমতা সব থেকে কম। ঘেঁষাঘেঁষি করে বহুতল তৈরির ফলে চাপে দুটি বাড়ির মাঝখানের মাটি বসে যায়। যার ফলে একে অপরের দিকে হেলে পড়ে ২টি বহুতল। এর সব থেকে ভালো উদাহরণ ট্যাংরার ক্রিস্টফার রোডে হেলে পড়া বহুতলটি। যে বহুতলটি হেলে পড়েছে সেটি বেশ কয়েকবছর আগে তৈরি হয়েছিল। এতদিন তাতে কোনও সমস্যা হয়নি। সম্প্রতি সেই বহুতলটির একেবারে গা ঘেঁষে নতুন একটি বহুতল উঠেছে। এর পরই হেলে পড়েছে পুরনো বহুতলটি।
বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে শুধু দৈর্ঘ্যে - প্রস্থে নয়, উচ্চতাতেও রয়েছে দুর্নীতি। যে সব জায়গায় মাটির চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কম সেখানে বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তলের বিধিনিষেধ রয়েছে। কোথাও তিন তলা, কোথাও চার তলা, কোথাও আবার পাঁচ তলার বেশি উঁচু বাড়ি তৈরি নিষিদ্ধ। সরকারি ভাবে ওই এলাকায় তার থেকে বেশি উঁচু বাড়ি তৈরির প্ল্যান পাশ হয় না। আর এখানেই খেলায় নামেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। অভিযোগ, স্থানীয় কাউন্সিলর বা বিধায়কের সঙ্গে যোগসাজসে তারা নির্ধারিত তলের বেশি আরও ১টি বা কোথাও ২টি তলা নির্মাণ করেন। তার পর তাকে ‘অ্যাজ় মেড’ নাম দিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে ওই বহুতল মাটির ওপর অতিরিক্ত চাপ দেয়। তার ওপরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত তল তৈরির মতো করে ভিত তৈরি করেন না প্রোমোটাররা। দুর্বল ভিতের ওপরে অতিরিক্ত তল তৈরি করায় ভবনের ভরকেন্দ্র ওপরে উঠে যায়। যা ভিতের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। এর জেরে হেলে পড়ে বহুতল। কলকাতা ও লাগোয়া এলাকায় বস্তি ও কলোনি এলাকায় যে বহুতলগুলি প্ল্যান পাশ করিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে তার অধিকাংশতেই অতিরিক্ত তল রয়েছে বলে অভিযোগ। বিরোধীদের দাবি, শাসকদলের আয়ের একটা বড় উৎসই হচ্ছে এই ধরণের বহুতলের প্রোমোটারদের থেকে টাকা আদায়। অবৈধ তলের জন্য স্কোয়ার ফুটে টাকা নেন বহু কাউন্সিলর। তার পর তাকে বৈধতা দিয়ে দেন।
সব জেনেও তবু শহরে বা শহরের কাছে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে এই ধরণের বাড়িতে ফ্ল্যাট কেনে সাধারণ মানুষ। আর বাড়ি হেলে পড়লে সব হারাতে হয় তাদের।