• পুরুষ নয়, বাজারে বেচাকেনা করেন মহিলারাই
    এই সময় | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • কৌশিক দে, মালদা

    দেখতে আর পাঁচটা ভরা বাজারের মতো। এক দিকে আলু, পেয়াঁজ, রসুন থেকে শুরু করে রকমারি আনাজ। অন্য প্রান্তে রয়েছে মাছ, মাংস, ডিমের দোকান। অন্য বাজারে যেমন নিত্যদিন ভিড় হয় এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু পুরুষের বদলে এই বাজারের বেচাকেনা করেন শুধু মহিলারাই। ইংরেজবাজার শহরে জহুরাতলা যাওয়ার আগে মাধবনগর এলাকায় বিশ্বনাথ মোড়। বাজারের এক দিকে এক নম্বর ওয়ার্ড। অন্য দিকে, ২ নম্বর ওয়ার্ড শুরু। দু’টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলারও আবার মহিলা। সংসারের হাল ধরতে তাঁদের উৎসাহ, পরিশ্রমের প্রশংসা করেছেন দুই কাউন্সিলার।

    বিশ্বনাথ মোড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাজারে বসেন ৪৯ জন মহিলা। অধিকাংশের স্বামী ভিনরাজ্যে। কেউ দিনমজুরি, কেউ আবার নির্মাণ শ্রমিক, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসমে কর্মরত। কারও স্বামী মারা গিয়েছেন। সংসারে হাল ধরতে, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ গড়তে প্রতিদিন ভোরে পাইকারি বাজার থেকে আনাজ কিনে এই বাজারেচলে আসেন তাঁরা। সারাদিন বেচাকেনা করে বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যার আগে।

    পারুল মণ্ডলের গোপালপুর গ্রামের বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার। ভোরে উঠে চলে যান ইংরেজবাজার নিয়ন্ত্রিত বাজারে। কেনাকাটা করে ভ্যানে বা টোটো করে চলে আসেন বিশ্বনাথ মোড়ে, বাজারে। তাঁর কথায়, ‘স্বামী দিল্লিতে দিনমজুরির কাজ করেন। বাড়িতে তিন ছেলেমেয়ে রয়েছে। একজন কলেজে ও দু’জন স্কুলে পড়ে। প্রথমে তো লজ্জা লাগত। ধীরে ধীরে লজ্জা কাটিয়ে এখন স্বনির্ভর হয়েছি। তিন থেকে চার মাস পরে স্বামী টাকা পাঠায় ঠিকই কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। সংসারটা তো চালাতে হবে। বাড়িতে অনেক খরচ। তাই আনাজ বিক্রি করে এখন রীতিমতো নির্ভরশীল হয়েছি। সংসার চালানোর ক্ষেত্রে অন্যের উপর ভরসা করে থাকতে হয় না।’

    ইংরেজবাজার ব্লকের রায়পুর এলাকার গৃহবধূ নমিতা মণ্ডল বেগুন, মিষ্টি কুমড়ো, বিভিন্ন ধরনের শাক, টমেটো, শশা–সহ একাধিক আনাজ বেচাকেনা করেন বিশ্বনাথ মোড়ের বাজারে। তিনি বলেন, ‘বয়স পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। বাড়িতে বড় সংসার। বৃদ্ধ শ্বশুর–শাশুড়ি, দুই ছেলেমেয়ে, ননদ রয়েছে। স্বামী কেরালায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। সংসার চালাতে জন্যই এই বাজারে আনাজ বিক্রি করি। আমার দেখাদেখি গ্রামের অনেক মহিলা বাজারে আনাজ নিয়ে আসছেন। বেচাকেনা করে ভালোই রোজগার হচ্ছে।’ এই বয়সেও বাজারে আসেন কেন? নমিতা বলেন, ‘একা স্বামীর পক্ষে রোজগার করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৫ বছর আগে বাজারে যাওয়া শুরু করি। আনাজ বিক্রি করে ছাদ ঢালাই দিয়েছি। বাড়িতে টিভি নিয়েছি। ভালো মোবাইলও ব্যবহার করি।’

    বিশ্বনাথ মোড়ের মেয়েদের এই বাজারের নির্দিষ্ট কোনও নাম নেই। মাছ বিক্রেতা সবিতা মণ্ডল বলেন, ‘ইংরেজবাজারের নেতাজী মার্কেটের আড়ৎ থেকে সকাল সকাল মাছ নিয়ে এসে এখানে বিক্রি করি। অন্য বাজার থেকে এই বাজারে আনাজ, মাছ, মাংসের দাম অনেক কম। ফলে সকাল থেকেই ক্রেতাদের ভিড় হয়। কিন্তু এখানে কোনও স্থায়ী শেড নেই। তাই রাস্তার উপরে বসেই বেচাকেনা করতে হয়। পুরসভা ও প্রশাসন যদি সহযোগিতা করে, তাহলে অনেক মহিলা স্বাবলম্বী হতে পারেন।’

    ইংরেজবাজার পুরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলার সন্ধ্যা দাস বলেন, ‘ওই বাজারের অধিকাংশ মহিলা শাক–আনাজ, মাছ মাংস বিক্রি করেন। বাজারটি দীর্ঘদিনের পুরোনো। মহিলাদের পরিশ্রম এবং প্রতিদিন রোজগারের যে চেষ্টা সেটা প্রশংসনীয়। ওই এলাকায় একটি পাকা শৌচাগার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।’ ইংরেজবাজার পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান তথা ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার সুমালা আগরওয় জানিয়েছেন, বিশ্বনাথ মোড়ের আনাজ বাজারে ফাঁকা জায়গা নেই। পুরসভার কোনও জায়গা থাকলে অবশ্যই ওই মহিলা বিক্রেতাদের জন্য পাকাপাকিভাবে একটি শেড তৈরি করা যেতেই পারে। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

  • Link to this news (এই সময়)