এই সময়: ওই সময়টাই অনেক ভালো ছিল। স্কুলে পরীক্ষা আসছে আসছে ভাবটাকে ছাপিয়ে যেত হালকা একটা ভয় — পুজোর আগেই যে পরীক্ষা! অবশ্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যেত অন্য একটা ভালো লাগার অনুভূতি। পুজোবার্ষিকী বেরনোর সময়টাও তো এগিয়ে আসছে! শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ঢুকতেই চোখে পড়ত পড়ার টেবিলে রাখা মোটা পত্রিকাটা। খাওয়া ভুলে আগে সূচিপত্র গোগ্রাসে গিলে ফেলা। পছন্দের লেখকরা কে কী লিখলেন এ বারে?
কয়েক দশক পর পুজোবার্ষিকী কী আজও সেই অ্যাপিল নিয়েই আসে? এখন কি কেউ পুজোকে আদৌ মিস করে? একটা পুজো শেষ হলেই তো পরের পুজোর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যায়। আর পুজোবার্ষিকী? সে তো পয়লা বোশেখের কয়েক দিন পর থেকেই বার হতে শুরু করে।
এর উপর রয়েছে অন্য একটা চিন্তার বিষয়। বেশির ভাগ পড়ুয়াদেরই তো আজকাল ‘বাংলাটা ঠিক আসে না।’ যদি বাংলা পড়ার লোকজনই না থাকে, তা হলে পুজোবার্ষিকী দিয়ে কী হবে?
৪৮তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার ১৯০ নম্বর স্টলে পুজোবার্ষিকী প্রকাশ করার যৌক্তিকতা নিয়েই জমাটি আলোচনার আসর বসেছিল শুক্রবার সন্ধেয়। ‘এই সময় সংবাদপত্র’–র এই স্টলেই আড্ডা জমিয়েছিলেন দুই অতিথি, সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার এবং কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। শুরুতে কিছুটা আক্রমণাত্মকই ছিলেন তিলোত্তমা।
তিনি বলেন, ‘সবাই সাহিত্যপ্রেমী হবেন, এমনটা আশা করি না। পুজোবার্ষিকী তাঁদের কথা ভেবেই প্রকাশিত হয়, যাঁরা সাহিত্য পড়েন এবং ভালোবাসেন।’ হয়তো সাহিত্যিকের মধ্যে এই বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় যে তিনি জোর দিয়ে বলে ওঠেন, ‘যত দিন বাংলায় সাহিত্য রচনা হবে, ততদিন পুজোর পত্রিকা বার হবে।’
কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় জমাটি এই আলোচনাকে অন্য দিশায় নিয়ে যান। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘শহর এলাকায় পুজোবার্ষিকী হয়তো জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। কিন্তু মফস্সল এলাকায় এবং গ্রাম–বাংলায় তেমন নয়। কেন? কারণ সম্ভবত, মাটির সঙ্গে নিকট সম্পর্ক।’ দুই সাহিত্যিকই এক যোগে স্বীকার করেছেন, আজ থেকে ৩০ বছর আগে যত পুজোবার্ষিকী প্রকাশিত হতো, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি পুজোবার্ষিকী প্রকাশিত হয়। এর একটাই কারণ, পাঠক এবং চাহিদা — দুই–ই বেড়েছে।
তা হলে কি সবটাই উইন–উইন? পুজোর পত্রিকার পুরো বিবর্তনটাই কি ইতিবাচক? এমনটাও অবশ্য স্বীকার করেননি অতিথি দু’জন। তাঁরা জানিয়েছেন, পুজোবার্ষিকীর যে বিবর্তন হয়েছে, সেটা ব্যবসায়িক। এর প্রধান উদ্দেশই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিক্রি করে ব্যবসা বাড়ানো। কিন্তু তার পার্শ্ব–প্রতিক্রিয়ায় বহু নতুন সাহিত্যিক পেয়েছে বাংলা। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন এমন রয়েছেন যাঁদের ‘রীতিমতো প্রতিভাবান’ বলাই যায়।
এঁদের লেখা পড়ার জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করেন এমন পাঠকের সংখ্যাও যথেষ্ট। এই কারণেই দ্রুত বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছেন নতুন প্রজন্মের বাঙালি সাহিত্যিকরাও। তাই পুজোবার্ষিকীর জয়যাত্রা — চলছে, চলবে।