মৌমিতা মাহাত
(মৃত ঊর্মিলা মাইতির আত্মীয়া)
মহাকুম্ভে মৌনী অমাবস্যার রাতে হুড়োহুড়িতে পড়ে গিয়ে ছ’বার পাল্টি খেয়ে মাটি আঁকড়ে যখন উঠলাম, তখন বাঁ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছি না। পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। সঙ্গীদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ফোনেও পাচ্ছি না কাউকে। পরে এক জনের সঙ্গে যোগাযোগ হল। কয়েক ঘণ্টা পর খুঁজে পেলাম মা’কে। মা মানে ঊর্মিলা (ভুঁইয়া) দিদার ছোট মেয়ে অঞ্জনা ও জামাই কমল মাইতিকে আমি ছোট থেকেই ভালবেসে মা–বাবা বলেই ডাকি। ওঁরাও আমাকে মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। ভোর নাগাদ দিদাকে ছাড়া একে একে সবার খোঁজ পেলাম।
তখন দেহে মনে ক্লান্ত। বাঁ পায়ের অবস্থা আরও খারাপ। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সঙ্গমঘাট থেকে হাঁটতে হাঁটতে সকাল ১০টা নাগাদ মায়ের সঙ্গে গিয়ে পৌঁছলাম স্থানীয় মোতিলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে পুলিশ, স্বাস্থ্যকর্মীদের কত করে বললাম, ‘আমার পায়ে চোট লেগেছে। কিছু ওষুধ দিন।’ কেউ একটা ওষুধ পর্যন্ত দিল না!
কী মনে হল, ওই অবস্থাতেই হাসপাতালে আহতদের মধ্যে দিদাকে খোঁজ শুরু করলাম। ভাবলাম, দেখি যদি পাওয়া যায়। আহত প্রায় শ’খানেক হবে, তাঁরা হাসপাতাল জুড়ে এ দিক–ও দিক শুয়ে আছেন। আমি তো দিদাকে খুঁজে যাচ্ছি। পুলিশ-প্রশাসনের লোকজনদের হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঊর্মিলা ভুঁইয়া নামে কেউ এসেছেন?’ তখন তাঁরা জানালেন, নাম তো বলতে পারবেন না।’ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মেল না ফিমেল? বয়স কত?’ বললাম, ‘ফিমেল। ৭৯ বছর হবে।’
তাঁরা জানালেন, মৃতদের মধ্যে এই বয়সের পুরুষ কয়েকজন আছেন। তারপর আমাকে নিয়ে গেলেন মর্গে। মা তখন মর্গের বাইরে। মর্গের ভেতরে একের পর মৃতদেহ আমাকে দেখানো হল। শেষ পর্যন্ত ত্রিশ-বত্রিশটা দেহ দেখানের পর দিদাকে খুঁজে পেলাম। দৌড়ে বাইরে এসে মা’কে নিয়ে মর্গের ভেতরে গেলাম।
এরপর আমি ফোন করলাম খড়্গপুরে। বাকি আত্মীয়দেরও জানালাম। সবাইকে ধরাধরি করেও ময়নাতদন্ত করানো গেল না। শেষে আমি আধিকারিকদের বললাম, ‘আমাদের অন্তত একটা বড় অ্যাম্বুল্যান্স দিন, আমরা সাত জন আছি। না হলে সবাই ফিরতে পারব না। অ্যাম্বুল্যান্সে দিদাকে নিয়ে সবাই ফিরেছি শুক্রবার। ২৪ ঘণ্টার পথ আসতে সময় লাগল প্রায় ৪৪ ঘণ্টা।
ইতিমধ্যে মৃতদেহে পচন শুরু হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। শালবনী থেকে যোগাযোগ করে টাটানগরে গাড়ি থামিয়ে, আলাদা একটি গাড়ি ব্যবস্থা করা হয়। সেই গাড়িতেই আমরা মহিলারা চারজন এবং দিদির অ্যাম্বুল্যান্সে বাবা ও মেসো দু’জন মেদিনীপুরে ফিরলাম। চারদিন স্নান খাওয়াদাওয়া কিছু নেই। আমি যে পোশাক পরে গেছিলাম, সেই পোশাকেই ফিরলাম। সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে এলাম বুকের মধ্যে।