• কাঠের খেলনা গাড়ি নির্মাণের পরম্পরায় নতুন প্রজন্মও
    এই সময় | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • অর্ঘ্য বিশ্বাস ■ ময়নাগুড়ি

    এক ঝলকে দেখলে বোঝা মুশকিল, এটা কী। ভালো করে নজর করলে প্রথমেই চোখে পড়ে হেডলাইট জোড়া। তার পরে চারটি চাকা। পরম যত্নে তুলি বোলানো এ সবে। যেন ইউরোপের কোনও দেশের পতাকা আঁকা হয়েছে। লাল, সবুজ, হলুদ— নানা রঙে খেলনা গাড়ি। জল্পেশ মেলায় এ বারও কাঠের এই খেলনা গাড়ি বিক্রি হবে। এই গাড়ি অনেক শিল্পী পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তৈরি করে চলেছে।

    শৈব তীর্থ জল্পেশ ময়নাগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের অন্যতম দ্রষ্টব্য। মন্দিরকে ঘিরে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে মেলা বসে। তার অনেক আগে থেকেই মেলায় খেলনার পসরা নিয়ে বসা শিল্পীদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। এখনও অনেক শিল্পী পরিবার খেলনা তৈরি করে আসছেন বংশ পরম্পরায়। তবে নতুন প্রজন্ম অন্যান্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়ায় খেলনা তৈরিতে আগ্রহ কমছে। এর ব্যতিক্রম লক্ষ্মীরহাট গ্রামের বাসিন্দা গোপালচন্দ্র সরকারের দুই পুত্র।

    ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাঠের খেলনা গাড়ি তৈরির কাজ করে আসছেন গোপাল। তাঁর বড় ছেলে শুভদীপ একাদশ শ্রেণির ছাত্র, ছোট ছেলে পিন্টু মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। বাবার কাজে সহযোগিতা করতে মেলার আগেভাগে প্রতিবারই হাত লাগায় তারা৷ পড়াশোনার পাশাপাশি দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টা কাজও করে। বছরভর খুব একটা কাজের চাপ থাকে না। কিন্তু জল্পেশ মেলা শুরুর আগেভাগেই কোমর বেঁধে দুই ভাই নেমে পড়ে বাবার সঙ্গে।

    শুভদীপ বলে, ‘ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়ে এই কাজ শিখেছিলাম। প্রতি বছর বাবা খেলনা তৈরি করেন। মেলার আগে চাপ বেড়ে যায়। তাই আমরা দুই ভাই বাবাকে সাহায্য করতে এই কাজে হাত লাগাই।’ পিন্টুর কথায়, ‘সকাল-সন্ধেয় পড়াশোনা শেষ করে বাকি সময়ে বাবাকে সাহায্য করি। নইলে বাবার একার পক্ষে কাজ সামলানো মুশকিল।’ গোপালের স্ত্রী রাধারানিও এই কাজে হাত লাগান।

    গাছের গুঁড়ি পাইকারি দরে কিনে আনা হয়। সেগুলি কাঠের মিলে চেরাই করিয়ে তৈরি করা হয় ছোট ছোট টুকরো। সেই টুকরো জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় খেলনা গাড়ি। এরপর রঙের পালা। এর আদল অনেকটা মালবাহী লরির মতো। দিনভর ছয় থেকে সাত ঘণ্টা শ্রমে একশোটির মতো গাড়ি তৈরি হয়। খেলনা তৈরিতে বিশেষ বৈচিত্র বা দক্ষতার ছাপ আছে তা-ই নয়, তবে এই খেলনাই জল্পেশ মেলার ঐতিহ্যের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।

    দু'রকম মাপের গাড়ি তৈরি হয়। ছোট গাড়ি ৩০ টাকা, বড় গাড়ি ৫০-৬০ টাকা দরে বিক্রি হয় মেলায়। শুরুর দিকে কাঠের দাম তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই ছিল কম। পুঁজিও খুব একটা ছিল না। এখন কাঠের দাম অনেকটাই বেড়েছে। কমেছে লাভের অংশ। তবু পরের প্রজন্ম নেমেছে কাঠের গাড়ি তৈরিতে।

    জল্পেশ মেলা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের হলদিবাড়ি হুজুর সাহেবের মেলা, গৌড়িহাট মেলা, বাতাসি মেলা, হ্যামিল্টনগঞ্জ মেলা-সহ নানা জায়গায় পাড়ি দেয় সরকার পরিবারের তৈরি খেলনা গাড়ি। তবে জল্পেশ মেলায় এই গাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেকের শৈশবের স্মৃতি।

    ময়নাগুড়ি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কালীশঙ্কর রায় বলেন, ‘জল্পেশ মেলা মানেই কাঠের খেলনা গাড়ি। এটা ছাড়া এই মেলা এককথায় অসম্পূর্ণ। সবাই মেলায় এসে এটা-ওটা কেনার সঙ্গে এই জিনিসটার খোঁজ করেন।’ স্থানীয় কারিগরদের পাশাপাশি বিহার থেকেও বিক্রেতারা এই কাঠের খেলনা নিয়ে আসেন।

    জল্পেশ মন্দির ট্রাস্টি বোর্ডের সম্পাদক গিরীন্দ্রনাথ দেব বলেন, ‘কাঠের খেলনা গাড়ি দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে কারিগররা তৈরি করছেন। এক সময়ে মেলার মাঠে বসেই কারিগররা খেলনা তৈরি করতেন। চাহিদা বাড়ায় তা আগেভাগে তৈরি করে মেলায় আনছেন কারিগরেরা।’

  • Link to this news (এই সময়)