• সংসার টান‍তে কার্টু‍ন‍ সাজা, সেটাই এখন পেশা
    এই সময় | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • সমীর মণ্ডল, মেদিনীপুর

    বাবা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে দু’বেলা ভাত জোটানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। ঘরে একা মা। অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া রাজু বুঝে উঠতে পারছিল না, কী করবে। মেদিনীপুরের খয়রুল্লাচকে প্রায় আধপেটা খেয়েই দিন কাটত মা–ছেলের। কিন্তু, স্কুল বন্ধ করার ইচ্ছে ছিল না তার একেবারেই। পাড়ার এক পরিচিতের সঙ্গে বিয়েবাড়িতে কার্টুন চরিত্র সেজে রোজগার শুরু করে রাজু। কখনও মিকি মাউস, কখনও স্পাইডারম্যান, কখনও চার্লি চ্যাপলিন সেজে রাজু পৌঁছে যেত বিয়ে, অন্নপ্রাশন, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে।

    এখনও মনে পড়ে, প্রথম দিন কার্টুন চরিত্র সেজে রোজগার করেছিল ১৫০ টাকা। মনে হয়েছিল হাতে স্বর্গ পেয়েছে সে। প্রথম দিন বিয়ে বাড়ি থেকে কাজ সেরে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল, এ জন্য মায়ের কাছে মারও জুটেছিল রাজুর। বকুনি–মার জুটলেও কাজ বন্ধ করেনি সে। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা, পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে এ ছাড়া আর কোনও উপায় সে দিন তাঁর কাছে ছিল না।

    মেদিনীপুর শহরে কার্টুন–চরিত্র সাজার জন্য রাজুর বেশ নাম–ডাক হয়েছে এখন। প্রথম দিকে জড়তা থাকলেও পরিস্থিতির চাপে অর্থের সংস্থানকেই গুরুত্ব দিতে হয়েছে তাঁকে। আগে কার্টুন–চরিত্র সেজে যখন অনুষ্ঠান বাড়ির দরজায় দাঁড়াত রাজু, তখন তাঁকে দেখে হাসিঠাট্টা কম হতো না। কৈশোর মনে তার প্রভাবও পড়ত। রাগ হতো ভীষণ।

    ক্ষোভে–দুঃখে–কষ্টে সেই কার্টুন সাজা চেহারা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করত। তাঁর বয়সী অন্য ছেলেমেয়েদের অনুষ্ঠান বাড়িতে দেখে তাঁরও মনে হতো ওদের মতো যদি থাকতে পারত সে। কিন্তু সে ভাগ্য যে কোনও দিনই হবে না সেটা দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল রাজু। এই লড়াইটা নিজের সঙ্গে করতে করতে একটা সময়ে সেটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি।

    স্কুল–কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে এখন ২৩ বছরের তরতাজা যুবক রাজু। মেদিনীপুরে এখন তাঁর নাম–ডাক হয়েছে। বড় বড় অনুষ্ঠান বাড়িতে কার্টুন–চরিত্র সাজার ডাক পড়ে। এখন আর লজ্জা করে না। এটাই এখন পেশা। নিজের পেশাকে গর্ব করে বলতেও কুন্ঠা হয় ন‍া তাঁর। রাজু একা নন। এখন তাঁর সঙ্গে কাজ করেন আরও ৩০ জন। মেদিনীপুর শহর এবং সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বিয়ে, অন্নপ্রাশন, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে রাজুর কাছে কাজের বরাত আসে।

    একটা সময়ে একা জীবনযুদ্ধে লড়েছে সে। এখন আর একা নন। রাজু এখন দুঃস্থদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। নিজের সামান্য রোজগার থেকে দুঃস্থ শিশুদের পিকনিকে নিয়ে যান। ভালো লাগে কার্টুন–চরিত্র সেজে সকলের মনোরঞ্জন করতে। রাজু নিজেই বলেছেন, ‘১৩ বছর বয়সে প্রথম খড়্গপুরের একটি বিয়ে বাড়িতে জোকার সেজেছিলাম। সেটাই আমার প্রথম কাজ। বাড়িতে টিভি ছিল না। ছোটবেলায় ঠাকুমার ঝুলি, বাঁটুল দ্য গ্রেট, নন্টে ফন্টে দেখতে অন্য বাড়িতে যেতাম। তখন ভাবিনি কার্টুন সাজাই আমার পেশা হবে।’

    অভাবের জন্য এই কাজ শুরু করলেও সেটাই ভালো লেগে গিয়েছে। যতদিন ক্ষমতা থাকবে, কাজ চালিয়ে যাবেন বলে জানালেন তিনি। এখন রাজুর কাছে ২৫ রকম কার্টুন চরিত্রের পোশাক আছে। অভাবের তাড়নায় কাজ খুঁজছেন এমন বেশ কিছু যুবককে নিজের টিমে সামিলও করেছেন রাজু।

  • Link to this news (এই সময়)