সঞ্জয় চক্রবর্তী
চোখে ভোরের শিশির জমল কখন? কিছুতেই খেয়াল করতে পারল না ক্লাস সেভেনের সুরঞ্জনা। সে তো কাঁদেনি। কাঁদতেই চায়নি। একাই এসে দাঁড়িয়েছিল শিলিগুড়ি কলেজের পিছনে। রাস্তাটা নির্জন। তবে চারপাশে সরস্বতী পুজোর কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজে তার তেমন ভয় করছিল না।
স্কুলের পুজো মণ্ডপে বসে আচমকা বয়েজ় স্কুলের পার্থর মুখটা মনে পড়ে গিয়েছিল। তখন সুরঞ্জনা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখছে। পাড়ার ক্লাবে তবলা বাজাতে এসেছিল পার্থ। সে-ও ক্লাস সেভেন।
কী যে হয়েছিল সে দিন! তারপর থেকে আনমনা হয়ে গেল সুরঞ্জনা। পড়তে ভালো লাগে না। কথা বলতে ভালো লাগে না। কেবলই পার্থর মুখটা মনে পড়ে। এসে গেল সরস্বতী পুজো। সুরঞ্জনা হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিল কলেজের পিছনের রাস্তায়। পার্থও হাজির। সুরঞ্জনা অবাক, ‘পার্থ কী করে জানল?’ মিটিমিটি হাসতে হাসতে সে সুরঞ্জনার হাতটা ছুঁয়ে দিল। মুহূর্তে যেন গোটা পৃথিবী দুলে উঠল। তারপরে প্রেম থেকে পরিণয়, দু’টি হাত এক হয়েই থেকে গেল।
আশির দশকে পার্থ-সুরঞ্জনার প্রেম-কথা শিলিগুড়ি শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকী, বামপন্থী পার্থ বড় আদরের হয়ে উঠল বিরোধী পক্ষের ছেলেমেয়েদের কাছেও, ‘হ্যা রে পার্থ, তোরা প্রেম করিস? গল্পটা বল না!’
তখনও শিলিগুড়ি আড়ে-বহরে এতটা বাড়েনি। সবাই সবাইকে চেনে। কিন্তু ভ্যালেন্টাইনস ডে-র নাম শোনেনি। ছেলেমেয়েদের প্রেমের দিন সরস্বতী পুজো। সকালে গায়ে কাঁচা হলুদ, নিমপাতা মেখে স্নান। তারপরে এক ছুটে স্কুল অথবা কলেজে।
শাড়ি হোক বা পাঞ্জাবি, হলুদে হলুদে মাখামাখি। ছেলেরা কোনও রকমে স্কুলে অঞ্জলি দিয়ে দৌড়ত গার্লস স্কুলে। সে দিন স্কুলের দিদিমণিরা বেশ উদার হয়ে যেতেন। বিকেলে মেয়েরা চলে যেত শিলিগুড়ি কলেজের মাঠে। অতি সাহসীরা কলেজের পিছনের রাস্তায়। সকলেরই আড়চোখে কাউকে যেন খুঁজছে। সবার কপালে প্রেম যে জুটত, এমন নয়। তবে দিনভর স্বপ্নের সফর চলত। যাঁদের শিকে ছিঁড়ত তাঁদের উপরিপাওনা বন্ধু অথবা বান্ধবীদের কপট ঈর্ষা— ‘তুই কী লাকি রে!’
পুরোনো শিলিগুড়ি আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে গেলেও বাঙালির আবেগ এখনও অটুট। বাঘাযতীন পার্কে বসে আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াতে জড়াতে আজও মনের কথা বলতে চেয়েও পারে না কেউ। কেউ আবার অর্ধেক কথা বলার পরে আপ্রাণ খুঁজতে থাকে পরের শব্দটা। আবার কেউ একবগ্গা, ‘এমন দিনে কথাটা বলে দেওয়াই যায়!’