সুমন তেওয়ারি, আসানসোল: স্কুল প্রাঙ্গনে হোক কিংবা বাড়িতে। ক্লাব প্রাঙ্গনে হোক কিংবা টিউটোরিয়াল হোমে। রবিবার বাগ্দেবীর পাদপদ্মে অঞ্জলি দিতে খুদেদের হুড়োহুড়ি ছিল বাংলার সর্বত্র। পুজোর প্রস্তুতি পর্বেও ছিল তাদের সর্বাধিক দখলদারি। সকাল থেকে আলপনা দেওয়া, ফল কাটা, প্রতিমা সাজানো—কতই না কাজ। সেই সব কাজ হেলায় ফেলে একদল খুদে হাত পাকাচ্ছে মোবাইল চুরিতে! ওরা একদা স্কুলে পড়াশোনা করত। এখন স্কুলছুট। তাই জীবনের দর্শন ‘হীরক রাজার’ বাণী—‘পড়াশোনা করে যে, অনাহারে মরে সে…।’ অতঃপর, চুরি বিদ্যাকে মহাবিদ্যা ধরে সরস্বতী পুজোয় বাজারের ভিড়কে টার্গেট করেছে ওইসব খুদেরা।
ওরা আসলে চিনাকুড়ির খুদে গ্যাংয়ের সদস্য। সবার বয়স ৮-১২। অভাবি সংসার। পড়াশোনা বন্ধ অনেক আগেই। পেট চালাতে এখন ওদের বড় ভরসা চুরিবিদ্যা। সবার নেপথ্যে বড় বড় মাথা। গ্যাংটি দীর্ঘদিন ধরে দুষ্কর্মে সক্রিয়। পুজো-পার্বনের ভিড় ওদের মূল টার্গেট। বাজারে, দোকানে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হলেই মোবাইল উধাও। জেনে-বোঝার আগেই খুদেরা মিশে যায় ভিড়ে। তার সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। বড়দের দেওয়া টাস্ক কমপ্লিট। মোবাইলটি তাদের হাতে তুলে দিলে দিনের শেষে সামান্য রোজগার। এদিন, সেই টাস্ক নিয়েই চিত্তরঞ্জনের আমলাদোহি বাজারে ঢুকেছিল চিনাকুড়ির খুদে গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য। শেষরক্ষা আর হয়নি। ধরা পড়ে যায় এক সদস্য। তার বয়স মাত্র ১০। বাজারের পাবলিকই তাকে ধরে ফেলে। পরে পুলিস এসে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। জেরায় সে জানায়, একা নয়. টিমের আরও তিনজন খুদে অপারেশনে নেমেছে। বাকিরা সুযোগ খুঁজে ধাঁ।
রেল শহর চিত্তরঞ্জনের সবচেয়ে বড় বাজার আমলাদোহি। সরস্বতী পুজো বলে সকালে থিক থিকে ভিড়। বাজারের মিলন মন্দিরের রাস্তাতেও বসে পড়েছিলেন সব্জি বিক্রেতারা। সেখানেই ঝুঁকে পছন্দ করে ট্যমেটো কিনছিলেন এক ক্রেতা। তাঁর বুক পকেটে মোবাইল। হঠাৎই, চিলের মতো ছোঁ মেরে সেটি চম্পট দেওয়ার চেষ্ট করে ওই বালক। ক্রেতাও খুব সতর্ক ছিলেন। তৎপরতার সঙ্গে তার হাত ধরে ফেলেন। চোর…চোর…বলে চিৎকারও জুড়ে দেন। ক্রেতা-বিক্রেতারা সবাই চলে আসেন। প্রথমে তো কেউই বিশ্বাসই করতে পারেননি, যাকে চোর বলা হচ্ছে, সে আদৌ চুরির চেষ্টা করতে পারে কি না! গো-বেচারা চেহারা। নিষ্পাপ মুখ। ঠিকঠাক কথা বলতেও শেখেনি। কিন্তু, সবাই চেপে ধরতে গড়গড় করে সব বলে দেয় ওই খুদে। জানিয়ে দেয় বাকি তিনজনের অপারেশনে যোগ দেওয়ার কথাও। তার মুখের আধো আধো কথা শুনে তাজ্জব বনে যান ভিড় করা লোকেরা।
ততক্ষণে ঘটনাস্থলে চলে আসেন এক সিভিক ভলান্টিয়ার। পাকড়াও হয় খুদেকে একপ্রস্থ জেরা করেন। জানতে পারেন, কুলটি থানার চিনাকুড়ি থেকে তারা এসেছে। বাজারে আরও তিনজন রয়েছে। মোবাইল চুরি করতেই তাদের আসা। বড়রা তাদের এ কাজে পাঠিয়েছিল।
চিনাকুড়ি মোবাইল চোরদের আঁতুড়ঘর বলে পুলিস মহলে পরিচিত। বিভিন্ন জায়গায় স্কুলছুট খুদেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এখানে। বিশেষ করে মোবাইল হাতানোর কলাকৌশল শেখানো হয়। একটু অভিজ্ঞ হলে ‘খুঁটে খাওয়ার’ পরামর্শ দিয়ে বাজারে ছেড়ে দেয় বড়রা। বিনা পরিশ্রমে কাঁচা টাকা আয়। লোভ সামলাতে না পেরে নেমে পড়ে চৌর্যবৃত্তিতে। পুলিসের একটি সূত্র বলছে, চিনাকুড়িতে চুরির প্রশিক্ষণ অত্যন্ত উন্নত। তাই জামতাড়া, জামুড়িয়ার শ্রীপুর থেকেও খুদেরা আসে চোর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে। পটু হয়ে গেলেই তাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে হাত সাফাইয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে দুর্গাপুজো, কালীপুজোর ভিড়ে তাদের অপারেশন চালাতে দেখা গিয়েছে। এই প্রথম চিনাকুড়ির খুদে গ্যাং সরস্বতী পুজোকে টার্গেট করল। পুলিস সূত্রে জানা গিয়েছে, এরা যখন কোনও দিনকে টার্গেট করে সেদিন বিভিন্ন বড় শহরেই তারা ছড়িয়ে পড়ে। চিত্তরঞ্জনে ধরা পড়েছে মানে অন্যত্রও তারা অপারেশন চালানোর চেষ্টা চালিয়েছে।