‘আনম্যাচড’, দীপ্তি ডি’ক্রুজ খুনে ২০ বছর পরও ফিঙ্গারপ্রিন্ট খুঁজছে পুলিস
বর্তমান | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
শুভ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বার্ণিক দাস, কলকাতা: টিংটং...। কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করতে হয় না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে দেন মালকিন। এটাই রোজনামচা পরিচারিকার। কিন্তু ২০০৫ সালের ৪ মে একটু অন্যরকম ছিল। কলিং বেল তো বটেই, হাঁকডাকের পরও সাড়া মেলেনি একাকী বিধবা মহিলার। ততক্ষণে জমা হয়ে গিয়েছে প্রতিবেশীরা। চাপা স্বরে আলোচনা, ‘এই গরমে ওঁর শরীর-টরির খারাপ হল না তো!’ শেষমেশ খবর গেল থানায়। পুলিসের সাহায্যে ভাঙা হল তালতলা লেনের ওই বাড়ির দরজা।
দরজা ভাঙতেই চোখ কপালে উর্দিধারীদের। এক কদম পিছিয়ে গেলেন প্রতিবেশীরাও। উপুড় হয়ে পড়ে ৪৫ বছরের দীপ্তি ডি’ক্রুজ। মাথা, বুক, হাত, পিঠ— ধারালো অস্ত্রের কোপ পড়েছে পরপর। অন্তত ১০-১২টি। ঘরের মেঝে ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ডিউটি অফিসারের ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছল তালতলা থানার টিম। ২৫ বছরের পুরনো বাসিন্দা এই খ্রিস্টান মহিলা নিজের বাড়িতে খুন হয়েছেন, ততক্ষণে এলাকায় তা চাউর হয়ে গিয়েছে। কতটা নৃশংসভাবে খুন? ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, দীপ্তির শরীরে ১৩টি আঘাত। বাঁদিকের পাঁজর ভেঙে গিয়েছে। অর্থাৎ তদন্তকারীরা বুঝলেন, আততায়ী প্রৌঢ়াকে প্রবল জোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলেছে। তারপর একের পর এক কোপ।
কিন্তু আততায়ী কে? তদন্তে নামল লালবাজারের হোমিসাইড শাখা। ‘পিও’ অর্থাৎ, ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে গোয়েন্দারা দেখলেন ঘরের বেসিনে রক্তের দাগ। উপরে ঝুলছে তোয়ালে। তাতেও রক্তের স্টেইন। অর্থ, আততায়ী খুনের পর বেসিনে হাত ধুয়ে, তোয়ালে দিয়ে মুছেছে। বেসিনের কল, তোয়ালে থেকে নেওয়া হল ফিঙ্গারপ্রিন্টের নমুনা। শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। পরিচারিকা দিয়ে শুরু। একে একে সব আত্মীয়, প্রতিবেশী, স্থানীয় জমি-বাড়ির দালাল, প্রোমোটার। একাকী বৃদ্ধা মহিলার পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদ ছিল কি না, বাড়ি বিক্রি নিয়ে সমস্যা হয়েছিল কি না, সবকিছুই খোঁজ নিল পুলিস। কিন্তু সবই আউট অব রেঞ্জ।
প্রায় ৪০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর মিলল প্রথম ‘ক্লু’। জানা গেল, বাড়িতে কাঠের কাজ করার জন্য মাঝেমধ্যেই এক মিস্ত্রির আসা-যাওয়া ছিল। নাম শেখ সইফুদ্দিন মোল্লা। হুগলির আরামবাগের বাসিন্দা। ডাক পড়ল লালবাজারে। তাঁকে জেরায় মিলল নতুন মোড়। জানা গেল, দীপ্তির একটি বেকারি ছিল। আরও একটি কেনার পরিকল্পনা করছিলেন তিনি। সেই খোঁজ দেন সইফুদ্দিন। কিন্তু নথিপত্র ঠিক না থাকায় আর এগননি দীপ্তি। সেই আক্রোশেই কি খুন? না, ক্লিক করল না সেই অ্যাঙ্গেল। কিন্তু সইফুদ্দিনকে ‘ছাড়’ দেয়নি পুলিস। শুরু হয় আরও বিস্তারিত খোঁজখবর। জানা যায়, কাঠমিস্ত্রির স্ত্রীকে বেশকিছু গয়না উপহার দিয়েছিলেন দীপ্তি। তাহলে কি বাকি গয়না লোপাটের উদ্দেশ্যেই খুন? জড়িয়ে সইফুদ্দিন? বাড়ির আশপাশে থাকা কয়েকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জোগাড় করল পুলিস। ফের থমকাল তদন্ত। কারণ, ঘটনার দিন বা তার আগের দিনের ফুটেজে সেখানে সইফুদ্দিনের আনাগোনার কোনও প্রমাণ নেই। সইফুদ্দিনের সূত্র ধরে পুলিসের হাতে এসেছিল আরও এক কাঠমিস্ত্রির নাম। মহম্মদ ইসমাইল খান। কিন্তু, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তাঁরও কোনও নিশান নেই। মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা চালালেন গোয়েন্দারা। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গেও সইফুদ্দিন ও ইসমাইলের আঙুলের ছাপ মেলানো হল। উত্তর ‘আনম্যাচড’।
২০ বছর পরও সেই জায়গায় আটকে পুলিস। ঘটনাস্থলের নমুনার সঙ্গে ‘ম্যাচড’ ফিঙ্গারপ্রিন্ট খুঁজে চলেছে লালবাজার। অর্থাৎ, বিশ বছর পরও উত্তর ব্ল্যাঙ্ক। দীপ্তির আততায়ী আজও অধরা।