• ১৭ বছর আগে সিএ পড়ুয়ার পচাগলা দেহ উদ্ধার বাইপাসের জলাজমিতেই লুকিয়ে মৃত্যুরহস্য
    বর্তমান | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • শুভ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বার্ণিক দাস, কলকাতা: ২২ বছরের তরতাজা যুবক। নাম মণীশ আগরওয়াল। দমদমের বাসিন্দা। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া। ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে হঠাৎ নিখোঁজ। ৬ দিন পর অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি ফোন ট্র্যাক করে মিলল সন্ধান। সায়েন্স সিটি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে জলাভূমিতে লোকেশন। ঠিক আজ যেখানে প্রগতি ময়দান থানা। ছুটল পুলিস। কিন্তু পৌঁছে কপালে চোখ। পড়ে রয়েছে পচাগলা দেহ। মাথা ও শরীরের একাধিক জায়গায় গভীর ক্ষতচিহ্ন। কালিন্দীর বন্ধু, স্টক ট্রেডিং, মহিলা-যোগ, বেঙ্গালুরুর যুবক, টাকাপয়সার লেনদেন—২০০৮ সালের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে সন্দেহজনক পাঁচ-পাঁচটি ‘অ্যাঙ্গেল’ স্ক্যানারে এসেছিল গোয়েন্দাদের। কিন্তু জট আজও খোলেনি। মৃত্যুরহস্য লুকিয়ে সেই জলাজমিতেই।


    ক্যামাক স্ট্রিটের একটি চার্টার্ড সংস্থায় ‘আর্টিকেলশিপ’ করছিলেন মণীশ। পাশাপাশি চলছিল পড়াশোনা। পড়তে যেতেন লেক গার্ডেনসে একটি কোচিংয়ে। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে অফিসে যান মণীশ। সেখান থেকে বেরন বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ। ৬টা নাগাদ ফোনে কথা হয় মা রেখা আগরওয়াল ও বোন রিতু আগরওয়ালের সঙ্গে। দু’জনকেই জানান, টিউশন শেষে রাতে দমদমের বাড়িতে ফিরবেন। তারপর লেকটাউনের এক বন্ধুকে ৩টি মেসেজ পাঠান যুবক। ব্যাস, ফোন সুইচড অফ। আর বাড়ি ফেরেননি মণীশ। ৬ দিন পর উদ্ধার হয় পচাগলা, ক্ষতবিক্ষত দেহ। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, মাথায় ‘হোমিসাইডাল ইনজুরি’র জেরেই মৃত্যু। অর্থাৎ, খুন। 


    শুরু হয় তদন্ত। কিন্তু তিনদিন পরও ‘ব্রেক থ্রু’ পায়নি তিলজলা থানা। ১ মার্চ মণীশ আগরওয়াল খুনের তদন্তভার যায় সিআইডির হাতে। মেলে ‘প্রথম লিড’। ঘটনাস্থল থেকে কিছুদূরে উদ্ধার হয় মণীশের মোবাইল ফোন। দেখা যায়, ফোনের যাবতীয় ইনকামিং-আউটগোয়িং মেসেজ ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে। তা পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠানো হয় ফরেন্সিকে। শেষ কার সাথে কথা বলেছিলেন মণীশ? কী কথা হয়েছিল? ফরেন্সিক রিপোর্টে মেলে ‘দ্বিতীয় লিড’। উঠে আসে লেকটাউনের কালিন্দী এলাকার এক বাসিন্দার নাম। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ভবানী ভবন থেকে বেরিয়ে পড়ে টিম। গন্তব্য লেকটাউন। 


    কিন্তু জেরায় সেই যুবকের দাবি, ‘আমার সঙ্গে মণীশের বহুদিনের বন্ধুত্ব। স্টক ট্রেডিং করতাম।’ কিন্তু সেই দাবি উড়িয়ে পরিবার জানায়, ‘কোনওদিনই স্টক ট্রেডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না মণীশ।’ সন্দেহ আরও দানা বাঁধে। কিন্তু, বন্ধুকে খুনের স্বপক্ষে কংক্রিট কোনও মোটিভ বা প্রমাণ কিছুই মেলেনি। কিন্তু জেরায় বেরিয়ে আসে অন্য অ্যাঙ্গেল। জানা যায়, রাজারহাটের বৈদিক ভিলেজ রিসর্টে নিয়মিত যাতায়াত ছিল মণীশ ও তাঁর এই বন্ধুর। এমনকী ২১ ফেব্রুয়ারিও সেখানে গিয়েছিলেন মণীশ। সারারাত সেখানেই কাটান। রাতভর পার্টিতে হাজির ছিলেন একাধিক মহিলা। সব মহিলাকে তলব করেন তদন্তকারী অফিসার। আলাদা আলাদাভাবে ‘গ্রিলিং’ চলে ভবানী ভবনে। না, মেলেনি কোনও অকাট্য প্রমাণ। 


    মণীশের খুনি কে? চারদিকে হাতড়াচ্ছেন গোয়েন্দারা। তখনই হাতে আসে একফালি চাঁদের মতো আলোর দিশা। ‘তৃতীয় লিড’। তৎকালীন রাজারহাটের এক যুবকের সঙ্গে মণীশের নিয়মিত যোগাযোগের ‘প্রমাণ’ পান তদন্তকারীরা। জানা যায়, তাঁদের মধ্যে আর্থিক লেনদেনও হয়েছিল। পরে সেই যুবক বেঙ্গালুরুতে চলে যান। কিন্তু, সেই অ্যাঙ্গেল দিয়েও খুনের মোটিভ অধরা সিআইডির দুঁদে গোয়েন্দাদের কাছে। সন্তানহারা বাবা-মা তৎকালীন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব প্রসাদরঞ্জন রায়ের সঙ্গে দেখা করেন। সুরাহা না মেলায় ‘জাস্টিস’ চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন তাঁরা। কিন্তু, লাভের লাভ কিছুই হয়নি। ১৭ বছর ধরে ছাত্র খুনের তদন্তে নিট ফল ‘শূন্য’ই।
  • Link to this news (বর্তমান)