• গুরুজির বাড়িতে মকবুল স্যরের সর্বধর্ম সম্মেলন
    এই সময় | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • হোমযজ্ঞের জোগাড়ে কাজী আবু জুম্মান। প্রতিমা সাজানোর ফুল এগিয়ে দিচ্ছেন জহিরুল ইসলাম।

    সোমবার সাত সকালে তুমুল ব্যস্ততা হাওড়ার কদমতলার বৃন্দাবন মল্লিক লেনের বনেদি বাঙালি পরিবার দীনেশ খাঁ–র বাড়িতে সরস্বতী পুজো নিয়ে। দীনেশবাবু সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান। ৫৯ বছর ধরে নিজের হাতেই সরস্বতী প্রতিমা বানান বাড়িতে পুজোর জন্য। গত কয়েক দশক ধরে দীনেশবাবুর এই কাজে প্রধান সঙ্গী হয়ে উঠেছেন তাঁরই ছাত্র ডঃ শেখ মকবুল ইসলাম। যিনি তাঁর গুরুজি দীনেশ খাঁ–র পথ ধরেই রয়েছেন সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল কলেজে বাংলার বিভাগীয় প্রধান পদে।

    হাওড়ার বাগনানের এক গরিব সুফিপন্থী মুসলিম পরিবারের সন্তান মকবুল স্যরের পড়াশোনা, শিক্ষকতা, জগন্নাথদেব নিয়ে গবেষেণা, সবকিছুই কদমতলায় এই হিন্দু পরিবারে। জগন্নাথদেবের উপর গবেষেণা করার বড় স্বীকৃতিও পেয়েছেন মকবুল স্যর। পুরীর মন্দির কর্তৃপক্ষের দেওয়া ‘নবকলেবর সম্মান’ পেয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে তিনি পুরস্কার নিয়েছিলেন স্বয়ং শঙ্করাচার্যের হাত থেকে। জগন্নাথ স্মরণ করলেও মকবুল স্যর নিজের ধর্মকেও সমান ভাবে খুবই সম্মান করেন। এই বাড়িতেই নিয়ম করে রোজা রাখেন। নমাজ পড়েন। আবার রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের পুজোপাঠও সারেন। সময় পেলেই ডুব দেন বৈষ্ণব পদাবলীতে। আর প্রথা মেনে করেন সরস্বতী পুজো।

    মকবুল স্যরের ছাত্রছাত্রীরাও এখন অংশ দেন এই সরস্বতী পুজোয়। যেমন এ দিন এসেছিলেন জুম্মান, যিনি শান্তিনেকতনে থেকে থার্ড থিয়েটারের উপর পিএইচডি করছেন। মুর্শিদাবাদের ছেলে জহিরুল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করছেন। এই সরস্বতী পুজোয় যোগ দিতে মিজোরাম থেকে আসেন বৌদ্ধভিক্ষু আর্যজ্যোতি ভিক্ষু। বারুইপুরের সেন্ট পিটার্স চার্চের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সৌরভ মাঝিও হাজির হন এই মহাধর্ম সম্মেলনে।

    পুজোর পরে নিজের স্টাডিরুমে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বসে মকবুল স্যর বলছিলেন, ‘প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে আমার বেশ কিছু পরিচিত মানুষ এই পুজোয় আসেন। এ বারও যেমন আসার কথা ছিল ডঃ সামসউদ্দিন শিশিরের। কিন্তু ভিসা সমস্যায় তিনি পৌঁছতে পারেননি।’ জুম্মান বলছিলেন, ‘আমি বেশ কয়েক বছর ধরে এই পুজোয় আসি। না এলে মনে হয়, সরস্বতী পুজোই সম্পূর্ণ হবে না।’ জহিরুলের কথায়, ‘এখানে এলে মন শান্তিতে ভরে যায়।’

    পুজোর পরে ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের প্রসাদ খাওয়ানোর ব্যস্ততার মাঝে ৭৯ বছর বয়সী দীনেশ খাঁ বলছিলেন, ‘কোনও পুজো বা উৎসবকে ধর্মের গণ্ডিতে বেঁধে রাখতে নেই। আমি সারা জীবন ধরেই সেই শিক্ষাই দিয়ে এসেছি ছাত্রছাত্রীদের। তাই আমার বাড়ির পুজোয় সকলের জন্যই দরজা খোলা।’

    বিশ্ব জোড়া ধর্মীয় উন্মাদনা ও বিভেদের মাঝে হাওড়ার খাঁ বাড়িতে বসন্ত পঞ্চমীতে যেন সর্বধর্মের মেলবন্ধন।

  • Link to this news (এই সময়)