কৃষক স্বার্থ এবং শিল্পায়ন দু’টির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেই এগোচ্ছেন মমতা, বুধবার থেকে শুরু বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন
আজকাল | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
জয়ন্ত ঘোষাল: মঙ্গলে ঊষা। বুধে পা। ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার থেকে কলকাতায় বসছে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের পসরা। দেশ ও বিদেশের তিরিশটির বেশি শিল্পগোষ্ঠীর ছ’শোর অধিক প্রতিনিধি যোগ দিতে চলেছেন এই সম্মেলনে।
দশবছর আগে এই সম্মেলন শুরু হয়। এর মধ্যে কোভিডের জন্য দু’বার হয়নি। তাই এবার অষ্টম বাণিজ্য সম্মেলনে প্রত্যাশা ৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব আসতে চলেছে।
আসলে শিল্প সম্ভাবনার বিষয়টির সঙ্গে সর্বদা যুক্ত হয় ‘পারসেপশন’ নামক বিষয়টি। বাস্তব এবং সৃষ্ট ধারণায় অনেক সময় বিশেষত আজকের পরাবাস্তবতার জীবনে বিরাট ফারাক থাকতে পারে। চার দশক ধরে দিল্লিতে থেকে আজ এই উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছি যে, পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার জন্য চিরকাল একধরনের ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র আছে। পশ্চিমবঙ্গ মানেই, 'নেহি চলেগা। নেহি চলেগা। এ রাজ্যে কোনও উন্নয়ন হয় না। এ রাজ্যটি হল বেকারদের জন্য। এ রাজ্যে কর্মসংস্কৃতি নেই। বাঙালি অলস। বাঙালি উন্নয়ন বিমুখ।' একই অসত্য রাজনৈতিক জগতে থেকে বারবার বলতে থাকলে তাকে সত্য বলে মনে হয় না।
বুধবার বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট শুরু হওয়ার প্রাক্কালে কতিপয় সামান্য তথ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরি। এগুলি রাজ্য সরকার নয়, কেন্দ্রেরই রিপোর্ট। প্রথমত, অসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রকের রিপোর্ট থেকেই জানা যাচ্ছে, ভারতীয় আকাশে বিমান চলাচলের রাজস্ব বাবদ সংগ্রহ অন্য বহু রাজ্য পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট বলছে, ২০২৩–২৪ সালে কলকাতা থেকে সংগ্রহ হয়েছে ১,৫৭৯ কোটি টাকা। বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকেও রাজস্ব সংগ্রহ কম নয়। দেশের মধ্যে সেরা দশ বিমানবন্দরগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান অনেকটাই উপরে। চেন্নাইয়ে এই রাজস্ব ১,২১২ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন কেন্দ্র বারাণসী। সেই বিমানবন্দরের জন্য তো অনেক বরাদ্দ ধরা হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব সংগ্রহ মাত্র ১৪১ কোটি টাকা। ইন্ডিগোর মতো বিমান কোম্পানি কলকাতা থেকে ফুকেট বিমান পরিষেবা চালু করেছে। যদি কলকাতা কোনও 'প্লেস অফ হ্যাপেনিংস' না হত তাহলে এত বিমান কীভাবে চলতে পারে?
বলা হয় এ রাজ্যে কর্মসংস্কৃতি নেই, কোনও পরিকাঠামো নেই। বেশ শুনলাম। এবার আপনাদের কাছে আরও একটি তথ্য তুলে ধরি। এটিও রাজ্য সরকারের রিপোর্ট নয়। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের রিপোর্ট। এই রিপোর্ট নানা শহরে নতুন নতুন অফিস ঘর লিজ নেওয়ার তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। কলকাতায় অফিসের জায়গা লিজ নেওয়াতে ২০২৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে এগিয়ে। ১.৫ মিলিয়ন স্কোয়ার ফুট লিজ নেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালে এই পরিসংখ্যান আরও বাড়বে এমন ভবিষ্যদ্বাণীও করা হচ্ছে। এইচডিএফসি থেকে ইনফোসিস, মাহিন্দ্রা থেকে শুরু করে আরও অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা পশ্চিমবঙ্গে এসে অফিস খুলছে। কলকাতার পরিকাঠামোর প্রতি যদি কোনও নেতিবাচক মনোভাব থাকত, তাহলে এত অফিস ঘর নিত এত বড় বড় কোম্পানি! গত দশ বছরে কলকাতা শহরে কতগুলি পাঁচতারা হোটেল–রিসোর্ট তৈরি হয়েছে দেখেছেন তো। এই হোটেলগুলিতে তিলধারণের জায়গা নেই। ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই।
পশ্চিমবঙ্গে নাকি বিনিয়োগ হতে চায় না। সারাক্ষণ নাকি ধর্ষণ আর সন্ত্রাস? কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট থেকেই জানতে পারছি ইসক্রামেকো নামের কোম্পানি ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে হার্ডওয়্যার পরিষেবায়। ২০২৪-এর শেষ তিনমাসে হলদিয়াতেই বিনিয়োগ হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। জার্মান কোম্পানি উইনস্রথ ফার্নেস শিল্প করবে বলে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। টিভিএস মোটর কোম্পানি শিলিগুড়িতে একটি শিল্প এস্টেট গড়ে তুলছে। টাটা কনসালটেন্সি আইআইটির সঙ্গে মিলে বড়রকমের বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করছে। ব্রিটেনের বহু টেকনিক্যাল জায়েন্ট পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে আসছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ রাজ্যে শিল্প চান না? তিনি প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই ক্যালকাটা ক্লাবে এক বিতর্কসভায় যোগ দিয়ে বলেছিলেন ‘আমি চাই শিল্পায়ন। আমি চাই এ রাজ্যে শিল্পের জোয়ার আসুক। সিঙ্গুর নিয়ে জানি কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়। আসলে সিঙ্গুরে কৃষকদের স্বার্থকে ক্ষুন্ন করতে পারিনি।’ কৃষক স্বার্থ এবং শিল্পায়ন দু'টির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেই মমতা এগোতে চাইছেন আজও।
এবারও বাণিজ্য সম্মেলনে লোহা স্টিল, বায়ো টেকনোলজি, লেদার জুট প্রোডাক্টস, চা ও জেমস অ্যান্ড জুয়েলারি এই সমস্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ টানার লক্ষ্যেই এই সম্মেলন।