উপচে পড়া জনসমুদ্র। কুম্ভমেলার সঙ্গে তুলনা। তবু বাংলা বই কেন বিশ্বের দরবারে নিজেকে মেলে ধরে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন ক্লাউডিয়া কাইজ়ার। এশিয়া, আফ্রিকা, আরব দুনিয়ায় ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার বাণিজ্যিক প্রসার সংক্রান্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া বললেন, “আমি নিশ্চিত, বাংলায় দারুণ সব বই আছে। সেটা লোকজনকে জানাতে তো হবে! বিশ্ব মঞ্চে এখন ভারতের উপস্থিতি প্রকট হচ্ছে। এটাই সময়, শুধু হিন্দি নয়, বাংলা বা ভারতের অন্য ভাষাকে মেলে ধরার।’’ বইমেলায় গ্যেটে ইনস্টিটিউট তথা জার্মানির সুদৃশ্য প্যাভিলিয়নে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্তে কথা বলছিলেন তিনি।
২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টেই ভারত ‘গেস্ট অব অনার’ থাকাকালীন ভারতীয় সাহিত্যিক হিসেবে পুরোভাগে ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। তবু বহির্বিশ্বে বাংলার সাহিত্যিকদের পরিচিতি খানিকটা পিছিয়ে বলেই মানেন বইমেলার উদ্যোক্তা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের কর্তা ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার বইমেলা ‘মানুষের উৎসব’ বলে মেলে ধরা হলেও বাংলা বইয়ের বিশ্ব-বাজার তৈরিতে তা কতটা সাহায্য করে, তা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। বইমেলাকে নানা ভাবে সহায়তা করলেও রাজ্য সরকারেরও এ বিষয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা জানা যায়নি। ক্লাউডিয়ার অবশ্য অভিজ্ঞতা, ভারতে চেন্নাইয়ের বইমেলাও ইদানীং বইয়ের স্বত্ব বিক্রির বাণিজ্য মঞ্চ গড়ে তুলেছে।
ত্রিদিব অবশ্য মনে করেন, ‘‘অনলাইন প্রযুক্তির যুগে বইয়ের স্বত্ব বিক্রির জন্য বইমেলা করার তেমন মানে হয় না। অতিমারির বিচ্ছিন্নতার পরে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাও তা টের পাচ্ছে।’’ ফ্রাঙ্কফুর্টে আগের মতো সাত-আট হাজার প্রকাশকের স্ট্যান্ড ইদানীং দেখা যাচ্ছে না, তা অস্বীকার করেন না ক্লাউডিয়াও। তবে তিনি বলছেন, “অনলাইন মাধ্যমে চুক্তির সুবিধা থাকলেও বিভিন্ন প্রকাশকের মুখোমুখি বসার উপযোগিতা ফুরিয়েছে বলে মনে করি না। পরে অনলাইনে চুক্তি চূড়ান্ত হলেও মুখোমুখি বসেই আস্থার ভিত তৈরি হয়। তা ছাড়া ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় এখনও লেখক, প্রকাশক, এজেন্টদের মধ্যে হঠাৎ দেখাতেও ভবিষ্যতের নতুন সম্পর্কের সূচনা হয়। তার মূল্য কমেনি।”
একটি সমীক্ষা বলছে, ইউরোপে ফ্লেমিশের মতো অপ্রধান ভাষায় ভাষান্তরের ব্যাপ্তিও বাংলাকে টেক্কা দেয়। আর ইংরেজি, মান্দারিনের পরে জার্মান ভাষাতেই সব থেকে বেশি বইয়ের তর্জমা হয়। ক্লাউডিয়া বলছিলেন, ‘‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা কাটাতেই জার্মানি ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা এবং বিভিন্ন বই ভাষান্তরের শক্তিতে জোর দিয়েছে।’’ শেষ বার ১৯৯৭-এ আগুন লাগার বছরে কলকাতা বইমেলায় আসেন ফ্রাঙ্কফুর্টের উদ্যোক্তারা।
এ বার ত্রিদিবের সঙ্গে আলোচনায় ক্লাউডিয়া বলেন, ‘‘আপনাদের বাংলা থেকে ভাষান্তরের বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্যোগী হওয়া উচিত।’’ আনন্দবাজারকেও তিনি বলেন, ‘‘ভাষান্তর বা ফেলোশিপের বিভিন্ন প্রকল্প থাকলে কলকাতা বইমেলা আরও সফল হতে পারে। তা ছাড়া ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলাতেও পশ্চিমবঙ্গ নিজেদের স্ট্যান্ড বা জায়গা রাখতে সচেষ্ট হতে পারে।’’
প্রধানত প্রকাশক, এজেন্টদের যৌথতার মঞ্চ হলেও ফ্রাঙ্কফুর্টেও সপ্তাহান্তে জনসাধারণ বই কেনেন। ই-বুকের যুগেও বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ক্লাউডিয়া বললেন, ‘‘তরুণ পাঠকদের টানতে আমরা কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্টে রোম্যান্স সাহিত্যের হাব (কেন্দ্র) তৈরি করেছি।’’ কলকাতা বইমেলায় ইদানীং রাজনৈতিক ভাবে স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলা বা প্রতিবাদ নিয়ে আপত্তি শোনা যায়। গাজ়া, ইজ়রায়েলে যুদ্ধ শুরুর পরে জার্মানির ভূমিকায় কিছু মুসলিম দেশ এখন ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা থেকে মুখ ঘুরিয়েছে বলে জানালেন ক্লাউডিয়া। তবে তিনি বলছেন, ‘‘ফ্রাঙ্কফুর্টে যে কোনও বিষয়ে আলোচনা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জানলা খোলা।’’