এই সময়: রাজপথ যতটা অগোছালো, মেট্রো ততটাই গোছানো। দেশের রাজধানীতে যানজটে এক বার যিনি ফেঁসেছেন তিনি যে বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্যে ভুগতে চলেছেন, এ এক রকম অনিবার্য। কিন্তু মেট্রোর মসৃণ গতি এক বারের জন্যেও থমকায় না। এই কারণেই ‘রাজপথের’ দিল্লি আর ‘মেট্রোর’ দিল্লিতে আকাশ–পাতাল তফাত।
হয়তো সেই কারণেই দিল্লির বাসিন্দাদের কাছে ৩৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রো আশীর্বাদের মতো। পরিষেবা শুরুর পর থেকেই লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে দিল্লি মেট্রোরেল কর্পোরেশন (ডিএমআরসি)।
দিল্লির বাসিন্দাদের কাছে মেট্রোরেল যেমন যানজট থেকে মুক্তির দরজা খুলে দিয়েছে, ঠিক তেমনই কলকাতা মেট্রোও হয়ে উঠেছে শহরের ‘লাইফলাইন’। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দিল্লি মেট্রো যে লাভের মুখ দেখেছে, কলকাতা মেট্রো তার ধারে–কাছেও নেই। লাভ দূরে থাক, বেড়ে চলেছে লোকসানের বহর।
কলকাতা মেট্রোর অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভারতীয় রেলের এক আধিকারিকের মন্তব্য, ‘অপারেটিং রেশিয়ো কমানো যাচ্ছে না কোনও ভাবেই।’ সদ্য বাজেট পেশ করা হয়েছে সংসদে। তার পর রেলমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, বাংলার জন্যে রেলের খাতে ১৩,৯৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন, ১৯৮৪ সালে কলকাতা মেট্রোরেল পরিষেবা শুরু হওয়ার পর থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত মেট্রোপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৮ কিলোমিটার। কিন্তু পরের মাত্র ১০ বছরে, অর্থাৎ ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে কলকাতার মেট্রোপথ ৩৮ কিলোমিটার বেড়েছে। রেল মন্ত্রক জানাচ্ছে, এ পর্যন্ত কলকাতার মেট্রোপথ সম্প্রসারণে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
বিনিয়োগের পরিমাণ প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু উপার্জন? রেল মন্ত্রক–সূত্রে জানা যাচ্ছে, কলকাতা মেট্রো বিপুল লোকসানেই চলছে। ২০২১–এ মেট্রোর অপারেটিং রেশিয়ো ছিল ৬৭১! অর্থাৎ মেট্রো কর্তৃপক্ষকে ১০০ টাকা উপার্জনে ৬৭১ টাকা খরচ করতে হতো। পরের কয়েক বছরে সেই খরচ অনেকটাই কমানো সম্ভব হলেও এখনও অপারেটিং রেশিয়ো অত্যন্ত বেশি — ২৮০।
অর্থাৎ এখন মেট্রো ১০০ টাকা রোজগারের জন্যে ২৮০ টাকা খরচ করে। ব্যয়ের ধারে–কাছেও আয় না থাকার সম্ভাব্য কারণগুলির মধ্যে একটি হলো মেট্রোয় রোজগারের প্রায় সবটাই আসে টিকিট বিক্রি থেকে। এ ছাড়াও স্টেশন ব্র্যান্ডিং থেকেও কিছু আয় হয়। এর পাশাপাশি রয়েছে, বিভিন্ন রুট পুরো চালু না হওয়া।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় অরেঞ্জ রুটের কথা। কবি সুভাষ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রুটে আপাতত রেক চলছে কবি সুভাষ থেকে রুবি মোড় পর্যন্ত। হয়তো এই কারণেই যাত্রীর সংখ্যাও সীমিত। এই রুটের যাত্রীরা মনে করেন, রুবির পরিবর্তে যদি পরিষেবা বেলেঘাটা পর্যন্ত পাওয়া যেত, তা হলে যাত্রীও অনেকটা বেশি হতো।
একই কথা বলা যায় পার্পল লাইন সম্পর্কে। জোকা থেকে বিবাদী বাগ পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রুট। তবে এখন ট্রেন চলছে জোকা থেকে মাঝেরহাট পর্যন্ত অংশে। ফলে জোকা ও বেহালা অঞ্চলের যে যাত্রীরা মধ্য কলকাতার দিকে আসতে চান, তাঁদের মাঝেরহাট পর্যন্ত এসে কোনও লাভই হয় না। এই কারণেই পার্পল লাইনে এখন দিনে গড়ে তিন হাজার যাত্রী হয়।
অথচ বিপুল খরচ করে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। ভারতীয় রেলের কমার্শিয়াল বিভাগের আধিকারিকদের অনেকেই মনে করেন, বাণিজ্যিক দিকটা উপেক্ষা করে পরের পর রুট চালু করলে লোকসানের অঙ্ক বেড়েই চলবে।