• ভাঙন ঠেকাতে গঙ্গার তীরে প্রকৃতিই গড়ছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য
    এই সময় | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • রাকিব ইকবাল, উলুবেড়িয়া

    নদীর খাঁড়িতে জলের কিনারা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে ম্যানগ্রোভের অরণ্য। কাদামাটির আঠালো আস্তরণ ভেদ করে সাদা শ্বাসমূল উঠে আছে জমিতে। প্রায় এক কোমর জলে থাকা সেই ঘন সবুজ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল দেখলে সুন্দরবন বলে বিভ্রম হতে পারে। বাদাবনের ছবি দেখা যাচ্ছে গ্রামীণ হাওড়ার হুগলি নদীর পশ্চিম পাড় বরাবর ফুলেশ্বর-১১ ফটক, হিরাপুর, মদাই, কাজিয়াখালি, নবগ্রাম-সহ বিভিন্ন জায়গায়। গঙ্গাকে বাঁচাতে প্রকৃতি নিজেই ভূমিক্ষয় আটকনোর উপায় খুঁজে নিয়েছে।

    হুগলি নদীর পশ্চিম পাড়ে ভাঙন চলছে দীর্ঘ সময় ধরে। চন্দননগর থেকে হাওড়ার বোটানিক্যাল গার্ডেন, হাওড়া গ্রামীণ এলাকার বাউরিয়া থেকে জগদীশপুর, শ্যামপুরের পূর্ব বাসুদেবপুর থেকে গাদিয়াড়া, ভাঙন ক্রমবর্ধমান। শালবল্লা, বোল্ডার পিচিং, মাটির বস্তা, পলিকার্বোনেট জিও শিট দিয়ে ভাঙন ঠেকিয়ে জনপদ বাঁচানোর লড়াই করছে সেচ দপ্তর। তা-ও সব গিলে ফেলছে নদী।

    এমনই সময়ে হুগলি নদীর পাড়ে জন্মেছে ম্যানগ্রোভ। এর নাম সোনেরাসিয়া ক্যাসিওলারিস (Sonneratia caseolaris), আঞ্চলিক নাম ম্যানগ্রোভ অ্যাপল।

    হাওড়া গ্রামীণের বিভিন্ন জায়গায় হুগলি নদীর পাড়ে মাথা তুলেছে এই বিশেষ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ। ঘটনাচক্রে যে সব এলাকায় এই ম্যানগ্রোভ বেড়ে উঠেছে, সেখানে নদীর ভাঙন নামমাত্র। এই ম্যানগ্রোভ অ্যাপল সুন্দরবনের তিনশোর বেশি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির একটি অন্যতম লবণাম্বু উদ্ভিদ। শ্বাসমূল যুক্ত সোনেরাসিয়া ক্যাসিওলারিস গাছ শিকড়ের ঘন জাল বিস্তার করে ধরে রেখেছে নদীর পলি মাটিকে।

    হাওড়ায় এই লবণাম্বু উদ্ভিদের প্রথম খোঁজ পান বাগনান কলেজের বোটানির দুই শিক্ষক আক্রামুল হক ও অংশুমান সাহা। গত আট বছরেরও বেশি সময় ধরে উলুবেড়িয়া এবং সংলগ্ন এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে এই গাছের অস্তিত্ব খুঁজে বার করেন তাঁরা। গবেষণা ছাপা হয় আন্তর্জাতিক জার্নালে। আক্রামুল বলছেন, ‘জোয়ার–ভাটার সময় সুন্দরবন থেকে এই এই বিশেষ ম্যানগ্রোভের বীজ ভেসে আসা অস্বাভাবিক নয়।

    সেই বীজ খাঁড়ি, খাল ও নদীর সংযোগকারী জায়গায় থিতু হয়েছে। ধীরে ধীরে বংশবিস্তার করেছে। ফুলেশ্বর-১১ ফটক লাগোয়া আনামত বস্তির পাশে খাঁড়িতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল তৈরি হয়েছে। উলুবেড়িয়ার মদাই এলাকাতেও তা রয়েছে।’

    তবে আক্রামুলের আক্ষেপ, প্রশাসন এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। গাছগুলির শিকড় অত্যন্ত ঘন সন্নিবিষ্ট ভাবে জালের মতো বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। পাড়ের নরম কাদা ও জলসিক্ত পলিকে অনেক বেশি আটকে রাখতে সক্ষম।

    গাছের গোড়া জোয়ারের সময় ডুবলেও মাটির উপর খাড়া দণ্ডের মতো উঠে রয়েছে অসংখ্য তিন-চার ফুটের শ্বাসমূল। আক্রামুলের কথায়, ‘প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, এই গাছ সংরক্ষণ করতে পরামর্শ দেওয়া হোক সাধারণ মানুষকে। অনেকে এই গাছ কেটে ফেলেছেন। এই গাছের দ্রুত বংশ বিস্তারের প্রবণতা রয়েছে। তার সুপরিকল্পিত রোপণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে ভাঙন রোধ সম্ভব।’

    তবে এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিস্তার তুলে দিয়েছে আর এক জরুরি প্রশ্ন। সুন্দরবনের মোহনার নোনা জলে বেড়ে ওঠে ম্যানগ্রোভ। কলকাতা ও লাগোয়া জেলাগুলিতে গঙ্গার জলে নুনের মাত্রা বাড়ছে বলে আগেও প্রচুর গবেষণা হয়েছে। তবে কি গঙ্গার জলের মিষ্টত্ব ক্রমশ কমছে বলেই জন্মাচ্ছে এমন লবণাম্বু উদ্ভিদ?

    সুন্দরবন এলাকায় বন ও বন্যপ্রাণী নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে বালি নেচার ক্লাব অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ কনজ়ারভেশন সোসাইটি। সংস্থার সম্পাদক অনিল মিস্ত্রি বলছেন, ‘এই গাছ মিষ্টি জলেও ভালো বেড়ে ওঠে। গাঙ্গেয় অঞ্চলে এই গাছের বংশবিস্তার ইতিবাচক। এর শিকড় নদীর পলি ধরে রাখতে খুব কার্যকরী।’

  • Link to this news (এই সময়)