এই সময়: রাজ্য সরকারের প্যানেলে থাকা আইনজীবীদের একাংশের দক্ষতা ও নিষ্ঠার অভাব এবং গা–ছাড়া মনোভাব নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির পর এ বার বিরক্তি প্রকাশ করলেন বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু। হাইকোর্টে রাজ্য সরকারের আইনজীবীদের প্যানেল নিয়ে অসন্তুষ্ট বিচারপতি বসু প্রয়োজনে এ ব্যাপারে তাঁর পর্যবেক্ষণ–সহ চিঠি আইনমন্ত্রী মলয় ঘটককে পাঠাবেন বলে সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের একটি মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা হাইকোর্টগুলোয় সরকারি আইনজীবীদের প্যনেলে যোগ্যদের না–নিয়ে মুখ দেখে নিয়োগ করা হয় বলে অভিযোগ তোলেন। স্বজনপোষণ বন্ধ করে ব্যক্তিগত আস্থাভাজনদের পরিবর্তে সত্যিকারের যোগ্যদের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হিসেবে নিয়োগের পক্ষে সওয়াল করেন তিনি। বিচারপতি পারদিওয়ালা একটি মামলার রায়েই পিপি হিসেবে দক্ষদের নিয়োগের পক্ষে নিজের বক্তব্য জানিয়েছেন।
এই পটভূমিকায় কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বসুর অসন্তোষ প্রকাশ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ আইনজীবীদের একটা বড় অংশ। হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করা বর্ষীয়ান এক ক্রিমিনাল ল’ইয়ার বিচারপতি পারদিওয়ালার রায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় সরকারি প্যানেলে থাকা আইনজীবীদের দক্ষতা কতটা, সেটা প্রমাণিত হয়েছে তখনই, যখন এ রাজ্যে পুলিশ নিজেদের মামলায় সরকারি প্যানেলের বাইরে থেকে আইনজীবী নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
গত বছর রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, এখন থেকে পুলিশ তাদের মামলায় সরকারি প্যানেলের বাইরে থেকে নিজেদের প্রয়োজন মাফিক আইনজীবী নিয়োগ করবে। এমনকী, ওই আইনজীবীদের যাঁর যতটা ফি, সেটাই দেবে পুলিশ ডিরেক্টরেট। আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, এর থেকেই তো স্পষ্ট যে, কত ‘দক্ষ’ সব আইনজীবী সরকারি প্যানেলে থাকেন। প্রথমে হাইকোর্টে ওই ব্যবস্থা চালু হয়। তার পর কলকাতা ও জেলার অন্য আদালতগুলোতেও সরকারি প্যানেলের বাইরে থেকে আইনজীবীদের তাঁদের দাবি মতো ফি দিয়ে মামলায় নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য পুলিশ।
গত বছর ফৌজদারি মামলায় রাজ্যের প্যানেলে একেবারে ‘নভিস’ এবং অদক্ষ আইনজীবীর নিয়োগ দেখে কার্যত বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন বিচারপতি জয়মাল্য বাগচি। তিনি এক অযোগ্য আইনজীবীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপেরও নির্দেশ দেন। বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে দেখে বিচারপতি বাগচি অসন্তুষ্ট হয়ে রাজ্যের সিনিয়র আইনজীবীকে ডেকে তাঁকে পরামর্শ দেন প্যানেলে দক্ষ ও যোগ্য কৌঁসুলি নিয়োগ করার।
এমনকী, বিরক্ত বিচারপতি এজলাসেই খোলাখুলি জানিয়ে দেন, এই ভাবে সরকারের হয়ে মামলা লড়ার দায়িত্ব অযোগ্য আইনজীবীদের দেওয়া হলে বিষয়টি নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত জনস্বার্থ মামলা করার জন্য তিনি প্রধান বিচারপতির কাছে সুপারিশ করবেন। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি যে খুব একটা বদলায়নি, তার প্রমাণ সরকারি আইনজীবীদের প্যানেল নিয়ে গত সপ্তাহে বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসুর অনাস্থা।
সম্প্রতি রাজ্যের আইনজীবীদের প্যানেলে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। নতুন কয়েক জন আইনজীবী প্যানেলে এসেছেন। কিন্তু তাঁদের মামলা লড়ার ‘দক্ষতা’ দেখে হতাশ হাইকোর্ট। বিচারপতি বসুর হুঁশিয়ারি, ‘এ ভাবে চললে রাজ্যের প্যানেল থেকে এঁদের বাদ দেওয়ার সুপারিশ করব।’ মামলার শুনানির সময়ে সরকারি প্যানেলে থাকা আইনজীবীদের একাংশের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রায়শই ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ। বিচারপতি বসুরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আদালতের সার্বিক পর্যবেক্ষণ, রাজ্যের আইনজীবীদের মামলা লড়তে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তাঁরা হাজির হচ্ছেন না।
সরকারি প্যানেলে থাকা আইনজীবীদের একাংশ আবার মামলার কাগজ পড়ে আসছেন না। বিচারপতি বসুর বিস্ময়, ‘রাজ্যের প্যানেলের কয়েক জন আইনজীবীকে চিনতেই পারছি না। অনেককে হাইকোর্টে প্রথম বার দেখছি। এখন আলিপুর কোর্ট থেকে আইনজীবীদের নিয়ে এসে প্যানেলে জায়গা দেওয়া হয়। ফলে, যা হওয়ার, তা–ই হচ্ছে।’ তার পরেই বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু কড়া ভাবে বলেন, ‘পুরো বিষয়টিতে রাজ্যের কৌঁসুলির (গভর্নমেন্ট প্লিডার বা জিপি) নজর দেওয়া উচিত। না–হলে আমি আমার মতামত জানিয়ে সবটা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠাতে বাধ্য হব।