• নানা দেশ ঘুরে মেলায় মার্কিন-প্যালেস্তিনীয় কবি
    এই সময় | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • গ্রিক পুরাণে কিংবদন্তি কবি, গল্প বলিয়ে, সংগীতকার ছিলেন অর্ফিয়ুস। গোল্ডেন ফ্লিস-এর সন্ধানে তিনি ভ্রমণ করেছিলেন বহু পথ। এ যুগে অর্ফিয়ুসের মতোই খাঁটি সোনার সন্ধানে পৃথিবীর পথে পথ হাঁটেন নাথালি হ্যান্ডাল। কবিতায়, গল্প বলায়। তিনি মার্কিন-প্যালেস্তিনীয় কবি। বিশ্বের নানা দেশে ঘুরে পড়ান, লেখেন। সম্প্রতি এলেন কলকাতায়।

    মঙ্গলবার জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট হোটেলে এক বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে পাওয়া গেল নাথালিকে। অনুষ্ঠানের আগে একান্তে কথা বললেন ‘এই সময়’-এর সঙ্গে। নাথালিকে বলা হয় ‘কনটেম্পোরারি অর্ফিয়ুস’। সে প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘আমি নিজেকে বিশ্ব-নাগরিক মনে করি। পূর্ব-পশ্চিম দুই দুনিয়ার বিস্তারেই পা রেখে চলতে চাই। তাতেই বিচিত্র মানুষের প্রকাশ ঘটে।’

    এই যে প্রকাশ, তার পিছনে এক পারিবারিক গল্প শোনালেন নাথালি। তাঁর পরিবারের শিকড় বেথলেহেম। যিশু খ্রিস্টের জন্মভূমি। সেখানকার একটা সনাতন সংস্কৃতি আছে। কিন্তু নাথালির পরিবার নানা কারণে ঘরছাড়া। নিজের শিকড় যেহেতু কেউই ছাড়তে চান না, তাই সেই বেদনা থেকেই সমগ্র জগতের সঙ্গে লেখালিখির মধ্যে দিয়ে যোগস্থাপন করেন নাথালি। ঘর হারানোর যন্ত্রণা তিনি বয়ে বেড়ান— লালন করেন। সেই অভিজ্ঞানেই বিশ্বের প্রতিটি কোণের সঙ্গে বোঝাপড়া করেন।

    অনুষ্ঠানে তাঁর এক কবিতা-বইয়ের অনূদিত সংস্করণ প্রকাশিত হলো। বইয়ের নাম ‘জিয়োগ্রাফি অফ লস’। বাংলা অনুবাদে ‘অনুপস্থিতির মানচিত্র’। ব্রাত্য বসু, সুবোধ সরকার, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, যশোধরা রায়চৌধুরীর মতো খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিকেরা এই অনুবাদের কাজটি করেছেন। অনুষ্ঠানে ব্রাত্য বলছিলেন, ‘শিকড় থেকে ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আর্তিই নাথালির কবিতার প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে।’ তাঁর কথায় উঠে এল কাহলিল জিব্রান, সিলভিয়া প্লাথের মতো কবিদের কথাও, যাঁদের লেখাতেও মানুষের এই বহুবিচিত্র প্রকাশের সুর ধরা পড়ে। নাথালির কবিতাকেও সেই পঙক্তিতেই স্থাপন করতে চাইলেন ব্রাত্য।

    এই বইয়ের যুগ্ম সম্পাদক গৌতম দত্ত। প্রায় চার দশক ধরে তিনি আমেরিকা ও বাংলার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটি করছেন। এই প্রবাসী বাঙালি কবি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘ইতিপূর্বে সুনীলদার সঙ্গে আফ্রিকান-আমেরিকান কবিদের নিয়ে কাজ করেছি। এখন প্যালেস্তাইনের দুর্দশার দিনে এই চেনাজানা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে হয়েছে।’

    উদ্বোধনে গৌতমের কথা বললেন সুবোধ সরকার। জানা গেল, আমেরিকায় বঙ্গসংস্কৃতির প্রচার-প্রসারে গৌতমের নিরলস পরিশ্রমের কথা। সুবোধ বললেন নাথালির কথাও। বললেন— ঘরের ধারণা, ঘর হারানোর ধারণা, সীমান্তের ধারণা পার করে নাথালির কবিতা বলতে পেরেছে: আমি সর্বত্র আছি। এখানেই কবিতার জোর। সে সব কিছু ছাপিয়ে নিজের স্বতন্ত্র পরিচিতির জন্ম দিতে পারে।

    প্যালেস্তাইনে আজ অবিরত রক্তক্ষরণ। অস্ত্রবিরতি হলেও বিধ্বস্ত গাজ়ার পরিত্রাণের পথ দেখা যাচ্ছে না। তাই মাতৃভূমি বলতে নাথালির ক্ষয়ের কথাই মনে হয়। বললেন, ‘আমি মাতৃভাষার মধ্যে বড় হইনি। তাই আমার মধ্যে ভাষার সিম্ফনি কাজ করে যায়। আজকের ভাষায় ফিউশন। আমি তাই সব সময়েই অনুবাদ করে চলি। ভাবনার অনুবাদ, সংস্কৃতির অনুবাদ।’ ভাবনার ক্রমাগত সক্রিয়তাতেই বেঁচে থাকে আশ্চর্য কবিতাযাত্রা। কলকাতাকেও ছুঁয়ে গেলেন সে পথেই।

  • Link to this news (এই সময়)