• দুয়ারে হোমিয়ো-চিকিৎসা বন্ধ, মমতার হস্তক্ষেপ দাবি
    এই সময় | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • অরূপকুমার পাল, ঝাড়গ্রাম

    সনাতন ভুক্তা ও মংলি ভুক্তার নয় সন্তান। দুলাল শবর ও বেলা শবরের চার সন্তান। রেণুকা কোটাল ও সুখেন কোটালের দুই সন্তান। এঁদের ছেলেমেয়েরা সকলেই নাবালক। কিন্তু এই লোধা ও শবর সম্প্রদায়ভুক্ত মংলি–রেণুকারা কখনও হাসপাতালের মুখ দেখেননি। স্বভাবতই, তাঁদের ছেলেমেয়েদের অসুখ হলেও তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনই না তাঁরা। জঙ্গলমহলে বিনা পয়সায় মূলত তাঁদেরই চিকিৎসার জন্য আছে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘দুয়ারে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র’।

    ৪৪ বছর ধরে চলা সেই কেন্দ্র থেকেই তাঁরা চিকিৎসা পরিষেবা নিতেন। গত আড়াই বছর ধরে কেন্দ্রের আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর লোধা-শবরদের চিকিৎসা পরিষেবার জন্য বরাদ্দ টাকা বন্ধ করে দিয়েছে। যার ফলে এখন কার্যত বন্ধের মুখে ‘দুয়ারে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র’গুলি। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর দুই জেলাশাসকের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করেছেন রাজ্যের আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরের প্রধান সচিব। আর তাতেই ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখছেন লোধা-শবর সম্প্রদায়ের মানুষজন।

    এ বিষয়ে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপও দাবি করেছেন।এ রাজ্যের জঙ্গলমহলের বাসিন্দা লোধা-শবর সম্প্রদায়ের পেশা হল জঙ্গলের শুকনো কাঠ, পাতা থেকে শুরু করে ফল-মূল বিক্রি। প্রশাসনিক সূত্র অনুযায়ী, ঝাড়গ্রাম জেলায় প্রায় পনেরো হাজার লোধা-শবর সম্প্রদায়ের মানুষজনের বসবাস। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের উন্নয়নের জন্য ‘লোধা উন্নয়ন বোর্ড’ও গড়েছেন। ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর থেকে ট্রাইবাল সাব প্ল্যান্ট–এর (টিএসপি) অনুদানে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় ২৩টি ‘দুয়ারে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র’ চালু হয়।

    বর্তমানে যা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ১০টি এবং ঝাড়গ্রাম জেলায় ১৫টি এই কেন্দ্র রয়েছে। এই চিকিৎসা কেন্দ্রগুলি পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ২০২১-’২২ অর্থবর্ষ থেকে আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে। এর জেরে ‘দুয়ারে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র’গুলির চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসকেরা তাঁদের সাম্মানিকও পাচ্ছেন না।

    এরই মাঝে গত ৬ নভেম্বর রাজ্যের আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরের প্রধান সচিব ছোটেন ধেন্দুপ লামা ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসকের কাছ থেকে ‘দুয়ারে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র’গুলির বিষয়ে রিপোর্ট চেয়ে পাঠান। মূলত, এই চিকিৎসা কেন্দ্রগুলি বন্ধ করে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে। এর পরে, ২০ ডিসেম্বর ছোটেন ধেন্দুপ লামাকে চিঠি দিয়ে ঝাড়গ্রাম জেলায় লোধা-শবরদের জন্য ‘দুয়ারে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র’ চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হননি ওই দপ্তরের প্রধান সচিব ছোটেন ধেন্দুপ লামা। ফের ঝাড়গ্রাম জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য দপ্তর আধিকারিক এবং জেলা আয়ুষ দপ্তরের কাছে এই ক্যাম্পগুলির বিষয়ে রিপোর্ট চান জেলাশাসক।

    তাতে দুই দপ্তরই ক্যাম্প চালু রাখার পক্ষে মত দেয়। তার পর গত ১৭ জানুয়ারি দপ্তরের প্রধান সচিবকে ফের চিঠি দিয়ে ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক ‘দুয়ারে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র’ চালু রাখার পক্ষে সওয়াল করেন। এ দিকে, বিষয়টি জানতে পেরে লোধা-শবরেরা চিঠি লিখে ঝাড়গ্রাম জেলা প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে ‘দুয়ারে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র’গুলি চালু রাখার পক্ষেই সওয়াল করে বিস্তারিত জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, তাঁরা সকালে জীবন-জীবিকার সন্ধানে জঙ্গলে চলে যান। পাড়ায় যে সব হোমিয়োপ্যাথি সেন্টার চলে সেখানে তাঁরা ভালো চিকিৎসা পান। তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁদের আবেদন, যাতে ওই কেন্দ্রগুলি বন্ধ না হয়।

    জেলা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রের যে এসসিএ এবং টিএসপি প্রকল্পের আওতায় এই পরিষেবা চলত, তা অনেকদিন আগেই তুলে দিয়েছে সরকার। রাজ্যের ‘লোধা উন্নয়ন বোর্ডে’র চেয়ারম্যান বলাইচন্দ্র নায়েক বলেন, ‘প্রায় আড়াই বছর হল কেন্দ্রীয় আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর ওই খাতে বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে। আমি নিজে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ফের চালু করেছিলাম। এ বার বিষয়টি নিয়ে আমি আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরের প্রধান সচিবকে চিঠি লিখেছি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সমস্যার কথা জানাব, যাতে লোধাদের দুয়ারে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা পরিষেবা সচল রাখা যায়।’

  • Link to this news (এই সময়)