• ক্লাসরুম থেকে খেলার মাঠ, অকাল ‘বার্ধক্যকে’ কিস্তিমাত নিখাতের
    এই সময় | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • বিশ্বদেব ভট্টাচার্য, আসানসোল

    প্রোজেরিয়া। ২০০৯ সালে বলিউড সিনেমা ‘পা’ মুক্তি পাওয়ার পর অতি বিরল দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়ার এই রোগ নিয়ে বেশ চর্চা হয়েছিল। খুব বুদ্ধিমান এক স্কুলপড়ুয়া অরোকে (অভিনয়ে অমিতাভ বচ্চন) নিয়ে ছিল সেই সিনেমা। বয়স ১২ বছর হলেও, শারীরিক ভাবে তাকে পাঁচ গুণ বেশি বয়সি দেখাত। ঠিক যেমনটা দেখায় পশ্চিম বর্ধমানের বার্নপুরের নরসমুদা জনকল্যাণ হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী নিখাত পরভিনকে। শারীরিক গঠন নিয়ে যদিও তার কোনও মাথাব্যথা নেই। স্কুলে যাতায়াত মিলিয়ে রোজ চার কিলোমিটার পথ হেঁটে পার করে সে। ক্লাসে যেমন প্রথম হয়, তেমন স্কুল স্পোর্টসে ভিক্টরি স্ট্যান্ডের ফার্স্ট ডায়াসে হাসিমুখে দাঁড়ায়। শাড়ি পরে বন্ধুদের সঙ্গে সরস্বতী পুজোর অঞ্জলিও দেয় হইহই করে।

    আসানসোলের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের কালিকাপুর সায়েরপাড়ায় নিখাতদের বাড়ি। বাড়িতে বাবা–মা ও দিদার সঙ্গে ওরা তিন বোন, এক ভাই থাকে। তার ছ’বছর বয়সি ছোট বোন বিশেষ ভাবে সক্ষম। প্রায় শয্যাশায়ী। মার্বেল মিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন নিখাতের বাবা সিরাজউদ্দিন সিদ্দিকি। বলেন, ‘২০১২ সালে ওর জন্মের পর আসানসোল জেলা হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা যখন মেয়েকে আমার কোলে দিলেন তখন তাঁরা বলেছিলেন, ও বেশি দিন বাঁচবে না। বলেছিলেন প্রোজেরিয়া রোগের কথা। এক কিলোর কিছুটা বেশি ওজন হয়েছিল ওর। মাথাটা ছিল তুলোর মতো নরম। শাশুড়ি ও স্ত্রীর কথা মতো বাড়ি নিয়ে এলাম। মায়ের দুধও খেতে পারত না ঠিক মতো। অনেক কষ্ট করে ওকে বড় করেছে ওর মা আর দিদা মিলে।’

    আর এখন? সিরাজউদ্দিন গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘এখন আমার মেয়ে ক্লাসে প্রথম হয়। এলাকার স্কুলগুলি নিয়ে আয়োজিত বিজ্ঞান মেধা প্রতিযোগিতায় তিন বছর ধরে নিজের স্কুলে প্রথম হয়ে আসছে। গত সপ্তাহে স্কুলের স্পোর্টসে অঙ্ক দৌড়েও প্রথম হয়েছে সে। কম্পিউটারে ওর খুব আগ্রহ।’ স্কুলের কম্পিউটার স্যর সৈকত চট্টরাজের কথায়, ‘বাড়িতে কম্পিউটার নেই বলে প্লাইয়ের উপর লিখে একটা কি–বোর্ড বানিয়েছে নিখাত। সেটায় বাড়িতে লেখা প্র্যাকটিস করে ও এখন এতটাই দক্ষ যে, চোখ বন্ধ করে কি–বোর্ডে নিখুঁত টাইপ করতে পারে। স্কুলের অনুষ্ঠানেও অংশ নেয়। এ বার সরস্বতী পুজোয় অন্য ছাত্রীদের মতো নিখাতও শাড়ি পরে অঞ্জলি দিয়ে গেল। ও আর একটু ভালো চিকিৎসা বা সরকারি সাহায্য পাক, এটাই চাই।’ প্রধান শিক্ষক দীপক মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘ইংরেজি ও বিজ্ঞান ওর সবচেয়ে পছন্দের। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করে। স্কুল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ওর বাড়ি। হেঁটেই স্কুলে আসে। হেঁটেই বাড়ি ফেরে।’

    প্রাণঘাতী প্রোজেরিয়া রোগে যেখানে কর্মক্ষমতা কমতে থাকে সেখানে এতটা পথ কী ভাবে হাঁটে নিখাত? বাবা সিরাজউদ্দিন বলেন, ‘হাঁটতে হাঁটতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে মেয়ের। হাঁপিয়ে পড়ে মাঝপথে। একটু জিরিয়ে নিয়ে ফের হাঁটা শুরু করে। টানা পড়াশোনা করতে পারে না। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফের পড়তে বসে। মাঝেমধ্যে তীব্র মাথা যন্ত্রণায় কষ্ট পায়। হাতের একাধিক আঙুল বেঁকে গিয়েছে। পায়ের নখ নেই বললেই চলে। শরীর খুবই কমজোর। টাকার অভাবে কখনও কোনও বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারিনি। শেষবার এক হোমিওপ্যাথ চিকিৎসককে দেখিয়েছিলাম। টাকা নিতেন না। এখন তিনি অন্যত্র চলে যাওয়ায় অনেকদিন ডাক্তার দেখানো হয়নি।’

    বছর আটেক আগে প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত এক শিশুকে দেখেছিলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ রোহিত কাপুর। তিনি বলছেন, ‘প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত ১৩ বছরের এক কিশোরী এখনও দৌড়-ঝাঁপ করছে, রোজ এতটা পথ হাঁটছে, এমনটা অসম্ভব নয়। হতে পারে, তার ডিজ়িজ় প্রোগ্রেশন হয়তো কিছুটা মন্থর। ওর শারীরিক বয়স হয়তো এখনও ৫০-৬০ বছরের কম। তাই ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক নয়।’

    কিন্তু চিকিৎসকদের কারও কারও মনে প্রশ্ন, ওই কিশোরী যে প্রোজেরিয়াতেই আক্রান্ত, তা কি নিশ্চিত ভাবে বলা যায়? তার কি জিন টেস্ট অথবা বোন সার্ভে হয়েছিল? কেন প্রশ্নটা উঠছে তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন আর এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রভাসপ্রসূন গিরি। বছর পনেরো আগে তিনি বিহারের একই পরিবারের তিন জন প্রোজেরিয়া রোগীকে দেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওয়ার্নার সিনড্রোম, এহলার ডানলোস সিনড্রোম প্রোজেরয়েড ফর্ম, হলারম্যান স্টেরিফ সিনড্রোমের মতো বেশ কিছু জিনগত রোগ আছে, যেগুলিতে প্রায় একই রকম প্রিম্যাচিওর এজিং দেখা যায়। তাই যথাযথ ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত ভাবে প্রোজেরিয়া বলা ঠিক নয়।’ যদিও ছবি দেখে তাঁরও এই কিশোরীকে প্রোজেরিয়া আক্রান্ত বলেই সন্দেহ হয়েছে।

    নিখাতের বাবা–মা, স্কুলের শিক্ষকরা নিখাত ভালো চিকিৎসা পাক, সেটাই চান। কিন্তু নিখাত নিজে কী চায়? সে বলে, ‘এই সবে ক্লাস সেভেনে উঠলাম। এখনও সব বই কিনতে পারিনি। কেউ জোগাড় করে দিলে ভালো হবে।’ না পাওয়া সেই বইটুকুই চাহিদা নিখাতের।

  • Link to this news (এই সময়)