• ধুলোর গোপন গন্ধ নিয়ে জেগে আছে বইমেলা
    এই সময় | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • মউলি মিশ্র

    এই মেলায় কোনও ধুলো নেই। মেলা আছে, ধুলো নেই! ফেব্রুয়ারির শুরুতেই দুপুরটা ঠিক বসন্ত–বসন্ত নয়। কিন্তু কে বলবে সে কথা? ওই যে ক্ষীণ, শীর্ণ মুখের তরুণীটি বেসামাল হাঁটতে হাঁটতে হলুদ পাঞ্জাবির গায়ে ঢলে পড়লেন, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, কিন্তু ওই ঠেকাঠেকির ঠেলায় তাঁর হাল্কা ব্রণ–ওঠা চিবুকে রক্তের এক ঝলক এসেই যে মিলিয়ে গেল, দু’হাত জোড়া কাপড়ের বই–ভরা ব্যাগে, আর হলুদ পাঞ্জাবি মাথা নিচু করে তাঁর কানের কাছে মুখ নামিয়ে কী একটা বলে নিজেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ফেললেন... এঁদের দেখলে কে বলবে, বসন্ত চলে গিয়েছে? সে রোদ্দুর যে কথাই বলুক।

    বই আর বই ভরার নকশা করা কাপড়ের ব্যাগ, খাদির পাঞ্জাবি, বড় টিপ–ভরা কপাল, বিদেশ ভ্রমণ, পোষ্য পালন কিংবা বণ্যপ্রাণী সংক্রান্ত স্টল, সরভাজা, কড়াইশুঁটির কচুরি, মিষ্টি দই... উফ্‌ কী ভীষণ বাঙালি নস্টালজিয়ার এক তীর্থক্ষেত্র এই মেলা। আজও।

    উদাসী সাহেব, কোথা থেকে ‘বইমেলা স্পেশাল’ ঝুলো পাঞ্জাবি চড়িয়ে, তাঁর সোনালি, এলোমেলো চুল ঠিক করছেন আনমনে, যেন রাস্তা ভুলে মেরে দিয়েছেন বিলকুল, তাঁর পাশে গিয়ে একটু দাঁড়াবেন নাকি নাক–উঁচু, নিখুঁত মেকআপ, পার্লার–চর্চিত বাঁধা চুল, নীল তসরের বাঙালি মেয়েটি? নাকি তিনি–ও অপেক্ষায় আছে অন্য কারও?

    এখনকার মেলায় যত্রতত্র ঢোল নিয়ে বসে পড়া তরুণ–তরুণীর দঙ্গল নেই, গাঁজা–টানা চেহারার মাউথ অর্গান বাজিয়ে নেই, যেমনটা থাকত ময়দানে। লিটল ম্যাগাজ়িনের সারিবদ্ধ স্টলের সামনে এই দঙ্গলকে টপকে অভিজাত স্টলের দিকে পা বাড়ায়, এমন সাধ্য কার ছিল! এখানেই এসে হাজির হতেন তাঁদের প্রিয় কবি, আসতে বাধ্য হতেন। আজকের এই নতুন মেলায় তাঁরা মিলেমিশে গিয়েছেন অন্য সবার মধ্যে।

    সদ্য অবসর পাওয়া, বিষণ্ণ যে প্রবীণ কাঁধে কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ নিয়ে স্টলে স্টলে অনিশ্চিত ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁর কি ফেলে আসা কোনও বইমেলার কথা মনে পড়ে গিয়েছে? ধুলোভরা মাঠে সে বার মাঝ মাঠে বসে ছবি আঁকছিলেন এক তরুণ। ১০০ টাকা দিয়ে একখানি নিসর্গ–চিত্র কিনে দিয়েছিলেন কেউ। বলেছিলেন, এইখানে যাব আমরা, একদিন।

    সে দিন হয়তো আর আসেনি। কিন্তু বইমেলা এসেছে, বছর বছর। একটু একটু করে প্রতি বারই নিজেকে বদলেছে এই মেলা। তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যতটা সম্ভব তাল মিলিয়ে সমকালীন হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে। ম্যাসকটের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে যে অনাবিল হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে পাঁচ বছরের শিশুটি, জোর করে টেনে আনছে তার জিন্স–টপের মা–কে, তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এই মেলায় একটুও দম বন্ধ লাগছে না তার। বিশেষ বিশেষ স্টলের সামনে সমানে চলছে সেলফি তোলা।

    কত ভাবে ‘হ্যাপেনিং’ করে তোলা যায় একটা মেলাকে, কিছু কিছু স্টলের সামনের ভিড় দেখলেই সেটা মালুম হয়। ‘এই সময়’–এর স্টলে চলছে অ্যাঙ্কর হান্ট, কোথাও ক্যুইজ় আর ইনস্ট্যান্ট পুরস্কার। পথচলতি ভিড় থমকে যাচ্ছে এই সব স্টলের সামনে এসে।

    বিশ্ব বাংলা শব্দটা নিয়ে বরাবরই মনে একটা ধন্ধ ছিল। কথাটার মানে কী? এটা কি সমাসবদ্ধ পদ? মানে শব্দ দু’টো কি জুড়ে লেখা হবে? সমাস ভাঙলেই বা কী দাঁড়াবে? বিশ্ব এবং বাংলা? নাকি বাংলার মধ্যেই বিশ্ব? গুলিয়ে যায় বারবার। এই মেলায় পৌঁছে মনে হলো, পুরোটা হয়তো বোঝানো যাবে না, কিন্তু বিশ্ব এবং বাংলা কোনও একটা সূক্ষ্ম তারে ঠিক জোড়া লেগে যাবে। অথবা ইতিমধ্যেই গিয়েছে! বইমেলা তার প্রমাণ।

    রাত গড়াচ্ছে আরও রাতের দিকে। কিশোরী কন্যা বই–ভরা ব্যাগ বুকে জাপটে ধরে জিজ্ঞেস করছিল, বাবা, ট্রেন পাব তো? হাওড়া–মেদিনীপুর লাস্ট লোকাল ক’টায়? মফস্‌সলি বাবা পাঞ্জাবির হাতায় মুখ মুছে মৃদু স্বরে বললেন, চল, এ বার ফিরি।

    কে বলল, মেলা আছে আর ধুলো নেই? এই মেলার প্রতিটা স্টল জানে এই ধুলোর গোপন গন্ধ। প্রতি বার বইমেলায় সে তার গন্ধ ছড়িয়ে যায়। তারপর উড়ে যায় দূর দূর মফস্্‌সলে। কোনও ইন্টারনেট দুনিয়া বইমেলার এই গোপন সৌরভে দখল দিতে পারবে না।

  • Link to this news (এই সময়)