সঞ্জয় চক্রবর্তী
তিন দিন কাটতে না-কাটতেই আর মন টিকছে না। টিকবেই বা কী করে! উঁচু পাহাড়ের মাথায় বাংলো। লোকজন বলতে বাংলোর দু’চারজন কর্মী। বাংলোর সামনে একফালি মাঠ। তার চারপাশে পাইনের সারি। সেই সঙ্গে প্রবল ঠান্ডা।
রোগে ভরাক্রান্ত হয়েই তো তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে এখানে এসেছিলেন কয়েকটা দিন ছুটি কাটাতে। সেই সঙ্গে কিছু লেখালেখির ঝাড়াই-বাছাই পর্বও বাকি ছিল। বৃদ্ধ ফোন করলেন মৈত্রেয়ী দেবীকে। কন্যাসম মৈত্রেয়ী ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বৃদ্ধের কষ্ট লাঘবের জন্য।
মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী মনমোহন সেন তখন সিঙ্কোনার বড় অফিসার। শেষ পর্যন্ত মংপু বাজারের কাছেই সিঙ্কোনা প্ল্যান্টেশন কর্তৃপক্ষ মনমোহন সেনের বসবাসের জন্য যে বাংলো বরাদ্দ করেছিলেন, সেটিই ছেড়ে দেওয়া হল তাঁর জন্য। মংপুর নাম যখন লেখা হয়ে গিয়েছে তখন ‘তাঁর’ পরিচয় নিষ্প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানে কেবল শান্তিনিকেতন কিংবা জোড়াসাঁকোই নয়, রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে মংপুও।
সিঙ্কোনার জন্য বিখ্যাত হলেও মংপু মানে রবীন্দ্রনাথও। এমনকী, অবহেলায় পড়ে থাকা সেই সুরেল বাংলোকেও লোকে রবীন্দ্রনাথের কুঠি নামেই চেনেন। যেমন মংপুর বাজারের কাছে মৈত্রেয়ীর বাংলোটিকে লোকে রবীন্দ্রভবন নামে চেনেন। মৈত্রেয়ী দেবীদের এই বাংলোটিতে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে কেবল সেখানে মিউজ়িয়ামই গড়ে তোলা হয়নি, পর্যটকদের জন্য গেস্ট হাউস, অডিটোরিয়াম, কত কী!
কিন্তু যে বাংলোয় রবীন্দ্রনাথ প্রথম উঠেছিলেন, সেই উঁচু পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা একলা কুঠি ‘সুরেল বাংলো’ এখন যেন পোড়ো বাড়ি। ১৯৮৬ সালে পাহাড়ে আন্দোলনের সময়ে অগ্নিকাণ্ডের জেরে বাংলোটি পুড়ে যায়। তার পরে আর সেটির সংস্কারও হয়নি। মংপুর রবীন্দ্রভবনের পাশাপাশি সুরেল ভবন দেখতে পর্যটকদের উৎসাহ দেখা যায় না। অনেকে জানেনই না যে, রবীন্দ্রনাথ মংপুতে এসে প্রথম এই বাংলোতে উঠেছিলেন। কেবল মনে রেখেছেন, রবীন্দ্রভবনের কেয়ারটেকার শিশির রাউত-সহ সামান্য সংখ্যক কিছু মানুষ।
শিশির রবীন্দ্রনাথকে দেখেননি। তাঁর বাবাও নন। দেখেছিলেন শিশিরের দাদু। রম্ভি স্টেশনে নামার পরে পালকিতে চড়ে রবীন্দ্রনাথ মংপুতে পৌঁছেছিলেন। মংপুর দশ-বারো জন লোক সেই পালকি বয়ে আনেন। সেই দলে ছিলেন শিশিরের দাদুও।
তার পরে মৈত্রেয়ী দেবীর বাংলোয় রবীন্দ্রনাথ চলে এলে শিশিরের পরিবার ফাইফরমাস খাটার কাজে লেগে যান। মংপুর রবীন্দ্রভবনে যাঁরা যান তাঁরা অনেকেই চেনেন শিশিরকে। রবীন্দ্রনাথের মংপু বাসের প্রতিটি পুঙ্খনাপুঙ্খ যেন তিনি স্মৃতিতে এঁকে রেখেছেন। তাঁর গলায় নেপালি টানে রবীন্দ্রসঙ্গীত যাঁরা শুনেছেন তাঁরা অবাক হলেও মংপুর বাসিন্দারা শিশিরের এই রবীন্দ্র-খ্যাপামি দেখে অবাক হন না।
আদতে সিঙ্কোনার কর্মী তিনি, কিন্তু জীবন জুড়ে যেন রবীন্দ্রনাথই বয়ে বেড়ান। শিশির বলেছেন, ‘সুরেল হাউসে গুরুদেব থাকতে পারেননি। এমন নির্জন, তার উপরে ভীষণ ঠান্ডা পড়ত তখন। শেষ পর্যন্ত মৈত্রেয়ী দেবীরা নিজেদের বাংলোটি ছেড়ে দেন।’ ১৯৩৮ থেকে টানা দু'বছরে মোট চার বার মংপুতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৪১ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মংপুবাসের সময়েই তিনি লিখেছিলেন ‘জন্মদিন’, ‘নবজাতক’, ‘সানাই’। এক বার নিজের জন্মদিন পালন করেন এই রবীন্দ্রভবনে। সেখানে ডাকা হয় সিঙ্কোনার শ্রমিকদের। অনেকেই ভালো করে বাংলা বোঝেন না। কবিতা তো দূরের কথা। কিন্তু সৌম্যকান্তি বৃদ্ধকে দেখে তাঁদের ভালো লেগে যায়। ফলে লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকত।