• কী ভাবে ফেরানো যাবে আত্মহননের পথ থেকে, জোর যোগাযোগে
    আনন্দবাজার | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • আত্মহত্যার চেষ্টার পরে আশপাশে ছিলেন দু’ধরনের মানুষ। বিষয়টি নিয়ে যাঁরা কথা বলতে চান না এবং যাঁরা চান। যাঁরা বলতে চান, তাঁরা কেবলই জানতে চাইতেন, কী পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তিনি। কিন্তু কেউই জানতে চাননি, কেন এমন সিদ্ধান্ত? আত্মহত্যা প্রতিরোধে আয়োজিত দু’দিনের সম্মেলনে এমনই জানালেন এক তরুণী। আবার, সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর পরে তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে নিরন্তর কাটাছেঁড়া ও ব্যক্তিবিশেষকে দোষী সাব্যস্ত করার তাড়ায় যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি এই সিদ্ধান্তের কারণ পর্যালোচনা। আত্মহত্যার দায় কেবলই ব্যক্তির উপরে চাপানোর প্রবণতা যে আসলে নানা কাঠামোগত খামতি ঢেকে রাখার, সমষ্টিগত দায়িত্ব এড়ানোরই প্রয়াস, তা বললেন একাধিক বক্তা।

    ভারতে ২০২২ সালে আত্মঘাতী হয়েছেন প্রায় এক লক্ষ ৭১ হাজার মানুষ। ২০৩০ সালের মধ্যে এমন মৃত্যু অন্তত ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু কোন পথে?

    বক্তারা জানান, আত্মহত্যা কমানো তখনই সম্ভব, যখন স্বীকার করা হবে, প্রতিটি আত্মহত্যার নেপথ্যেই রয়েছে একাধিক কারণ। যখন সমাজের প্রতি স্তরে আত্মহত্যা ঠেকানোর আপৎকালীন ব্যবস্থা, পরিকাঠামো থাকবে। মনোরোগ চিকিৎসক লক্ষ্মী বিজয়কুমার বলেন, ‘‘আত্মহত্যার চেষ্টার পরে মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা-সহ কাউকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি এক জন কোমর ভাঙা রোগীর থেকে কম গুরুত্ব পান। মনোবিদের জন্য বসিয়ে রাখা হয়। দুটোই কিন্তু জরুরি পরিস্থিতি।’’

    মদ্যপানের সঙ্গে আত্মহননের যোগ প্রসঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য গবেষক অভিজিৎ নাদকার্নি বলেন, ‘‘কারও মনে এই ধরনের চিন্তা যখন এসেছে, তখন মদ্যপান দ্বিধা কমায়, আবেগ বাড়ায়। মিলিত ফল মারাত্মক।’’ এ দেশে মদ্যপান বাড়ছে। বিষয়টিকে আকর্ষণীয় উপায়ে হাজির করায় বৃহৎ পুঁজির হাত রয়েছে। আত্মহত্যার একটি বাণিজ্যিক নির্ধারক হল মদ, জানান অভিজিৎ। ট্রান্স মানুষদের আত্মহত্যায় মদ্যপানের বড় ভূমিকা আছে, জানালেন ট্রান্স-সমাজকর্মী অনিন্দ্য হাজরা। গানের সিডি বা পানীয় জলের মোড়কে মদের বিজ্ঞাপন বন্ধ করা এবং যত্রতত্র মদের দোকান কমানোর পক্ষপাতী বক্তারা।

    দারিদ্র, হিংসা, জাত-যৌন পরিচয়-লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে অসাম্যের মতো বহু কারণ রয়েছে যে সমস্যার মূলে, তা কমাতে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার— বলছেন বক্তারা। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচিং ফেলো নীরজ কুমার বলেন, ‘‘মূলত উচ্চবর্ণ, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও বিসমকামীদের চাহিদার বাইরে মানসিক স্বাস্থ্যে অবহেলিত বাকি সবাই।’’ আইনজীবী ও মনোবিদ অর্জুন কপূর বলেন, ‘‘যাঁরা আত্মহননের কথা ভেবেছেন বা চেষ্টা করেছেন, তাঁদের কথা বলার নির্ভীক পরিসর ও সহযোগিতার বৃত্ত তৈরির মাধ্যমে আমরা ভাল ফল পেয়েছি। আইনি অধিকারের মাধ্যমে অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও জোর দিই।’’

    ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় গুরুত্ব দেওয়া ও আলোচনায় যে ফল মেলে, তা জানিয়ে মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মৃত্যু আসলে কী, এমন আলোচনাও আত্মহননেচ্ছু কাউকে ফিরিয়ে এনেছে। পাশাপাশি দরকার মানুষের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ। সে শুধু পরিবার, জীবনসঙ্গীর সঙ্গেই হতে হবে, তা নয়।

    আয়োজক সংস্থার কর্ণধার রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘আত্মহত্যা ঠেকানো একটি ‘রোটি-কাপড়া-মকান’-এর মতো বিষয়। কেবল মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের এক্তিয়ার ভেবে রেখে দিয়ে বিষয়টি কার্যত ‘ডিজ়অর্ডার’ হিসাবে দেখা হয়। এটা যে হেতু পরিকাঠামোগত বিষয়, তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ও শিশু সুরক্ষা, সমাজকল্যাণ থেকে কৃষির মতো সব স্তরে আলোচনা বাড়াতে হবে। নীতি নির্ধারণে গুরুত্ব দিতে হবে দলিত ও প্রান্তিকদের। লড়াইয়ে শরিক করতে হবে গণমাধ্যমকেও। গণমাধ্যম পাশে না থাকলে মানসিক স্বাস্থ্য যে অধিকার, তা প্রতিষ্ঠা করা যেত না। আত্মহত্যা যে হেতু অপরাধ নয়, তাই সেই তথ্য ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোয় নথিবদ্ধ না করে বিকল্প ব্যবস্থা প্রয়োজন।’’

  • Link to this news (আনন্দবাজার)