এই সময়: পাঁচ বছর আগে ফেব্রুয়ারির এই প্রথম সপ্তাহে সারা দেশ ভুগতে শুরু করেছিল করোনা আতঙ্কে। দেশে বিক্ষিপ্ত ভাবে আক্রান্তের খোঁজ মিলতে শুরু করলেও, বাংলায় তখনও কোভিড রোগী কেউ চিহ্নিত হয়নি। ঠিক তার পরের বছর, অর্থাৎ এখন থেকে চার বছর আগে প্রতিদিন হাজারে হাজারে নতুন করোনা রোগী নিয়ে জেরবার হয়ে গিয়েছিল স্বাস্থ্য প্রশাসন।
আর এখন?
চিকিৎসক থেকে রোগী— সকলেই বুঝে গিয়েছেন, মামুলি সর্দি-কাশির বাইরে নভেল করোনা ভাইরাসের আর কোনও কামড় দেওয়ার তেমন মুরোদ নেই। ফলে সারা দুনিয়াকে সন্ত্রস্ত করে তোলা কোভিড এখন নিছকই সামান্য হাঁচি-কাশির পর্যায়ে নেমে এসেছে। তাই সংক্রমণের সন্দেহ থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কো-মর্বিডিটির কেস বাদে কারও আর কোভিড পরীক্ষাই হচ্ছে না। বছর দেড়েক হলো, টেস্ট হচ্ছে না হাসপাতালে ভর্তি কিংবা অস্ত্রোপচারের আগেও।
এ ছবি শুধু কলকাতারই নয়, বঙ্গের প্রায় সর্বত্রই। বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্য বলছে, করোনা রোগীর খোঁজ মিলছে না, কারণ তেমন কারও টেস্টই হচ্ছে না। ফলে ‘টেস্টেড পজ়িটিভ’ এই মুহূর্তে রাজ্য কত জন, তার তথ্য কেন্দ্রীয় ভাবে মজুত নেই স্বাস্থ্যভবনেও। রাজ্যে প্রথম করোনা ধরা পড়েছিল ২০২০-র ১৭ মার্চ। সেই রোগীর চিকিৎসক এসএসকেএম হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ যোগীরাজ রায় বলছেন, ‘করোনা সংক্রমণের এখন যা নির্বিষ চরিত্র, তাতে কেউ আক্রান্ত হলেন কী হলেন না, সাধারণ রোগীর জন্য তা জানারই কোনও ডাক্তারি প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই টেস্টও করানো হচ্ছে না।’
চেস্ট মেডিসিন তথা ক্রিটিক্যাল কেয়ারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উডল্যান্ডস হাসপাতালের সৌতিক পণ্ডা কিংবা ঢাকুরিয়া মণিপাল হাসপাতালের দেবরাজ যশ জানাচ্ছেন, তাঁরাও ঠিক এই কারণেই আর কোনও রোগীর কোভিড টেস্ট করাচ্ছেন না। একমাত্র যাঁদের শ্বাসকষ্টের উপসর্গ রয়েছে এবং অন্য কোনও সংক্রমণ চিহ্নিত হয়নি, তাঁদেরই কখনও কখনও করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
কিন্তু তাতেও খুব বেশি কোভিড ধরা পড়ছে না বলে জানাচ্ছেন পিয়ারলেস হাসপাতালের সিইও সুদীপ্ত মিত্র। তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে দু’-একটা কেস কখনও-সখনও পাই।’ একই সুর আনন্দপুর ফর্টিস হাসপাতালের চিফ নার্সিং অফিসার ডলি বিশ্বাসের গলাতেও।
সল্টলেকের টেকনো ইন্ডিয়া ডামা হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার মহম্মদ শাহনওয়াজ পুরকাইত বলেন, ‘গত ৮ মাসে আমরা মাত্র ৬ জনের নমুনা কোভিড পজ়িটিভ পেয়েছি। ওঁদের প্রত্যেকেরই ভয়াবহ কো-মর্বিডিটির সঙ্গে ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ ছিল। সে জন্যই টেস্ট হয়েছিল।’
দমদম আইএলএস হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিৎসক কুমার রাজ জানাচ্ছেন, জিনগত পরিবর্তনের পর করোনার যে নিরীহ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের উপ-প্রজাতি এখন সংক্রমণ ঘটাচ্ছে, তা একেবারেই প্রাণঘাতী নয়, বরং তাকে নিরীহ বলাই ভালো। তাতে সাধারণ সর্দি-কাশি-হাঁচির বাইরে তেমন গুরুতর অসুস্থতা আর কিছু হচ্ছে না।
বিপি পোদ্দার হাসপাতালের গ্রুপ অ্যাডভাইজ়ার সুপ্রিয় চক্রবর্তী বলেন, ‘শ্বাসনালীর সংক্রমণ নিয়ে কোনও রোগী এলে তাঁকে ১০ বেডের একটি আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখা হচ্ছে। তিন দিন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তখনই তাঁর অধিকাংশ টেস্ট হয়ে যাচ্ছে। এবং রোগীও পর্যাপ্ত চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে উঠছেন। ফলে আলাদা করে কোভিড টেস্টের প্রয়োজনই পড়ছে না।’
তিনি জানান, অহেতুক বাড়তি খরচের কথা মাথায় রেখেই আর কোভিড টেস্টের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না চিকিৎসকরা। অর্থাৎ স্পষ্ট, করোনা নিয়ে আর কেউ-ই তেমন মাথা ঘামাচ্ছেন না। ফলে পৃথিবীজোড়া অতিমারী যে মাত্র পাঁচ বছরেই নখদন্তহীন হয়ে পড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।