২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আতশবাবাজির আড়ালে শব্দবাজি তৈরির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন বাজি ব্যবসায়ী খোকন বিশ্বাস। মাত্র সাত দিন জেল খেটে জামিন পেয়ে যান। জেল থেকে বেরিয়ে আবার মন দেন বাজি কারবারে। শুক্রবার যে ‘অবৈধ কারবার’ চার জনের প্রাণ কেড়েছে। আবার গ্রেফতার হয়েছেন কল্যাণীর খোকন। কিন্তু তথ্য বলছে, খোকনের মতো এমন অনেক বাজি কারবারি রয়েছেন, যাঁরা অবৈধ ভাবে ব্যবসা করার অভিযোগে পাকড়াও হয়েছেন এবং কিছু দিন পর জেল থেকে বেরিয়ে আবার ‘বাজিগর’ হয়েছেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, ২০২৩ সালে জামিনে মুক্তির পরে বাজি কারখানা বহরে আরও বড় করেছিলেন খোকন। কল্যাণীর ২০ নম্বর ওয়ার্ডে রথতলা মোড়ে তাঁর বাজি কারখানায় কাজ করতেন বেশ কয়েক জন। কর্মীদের বেশির ভাগই মহিলা। যাঁরা সংসার সামলে বাড়তি কিছু রোজগারের আশায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মশলা মিশিয়েছেন, বাজি বানিয়েছেন। এ ভাবে কাজ করতে করতেই শুক্রবার কল্যাণীর দুর্গা সাহা, বাসন্তী চৌধুরী, রুমা সোনার, অঞ্জলি বিশ্বাস প্রাণ হারিয়েছেন।
কিন্তু কী ভাবে একই কাণ্ডে জেল খেটে আবার অবৈধ ভাবে সেই ব্যবসা করার সাহস দেখান খোকনেরা? বিস্ফোরণ, শ্রমিকমৃত্যু, মালিকের গ্রেফতারি, জামিন এবং ফিরে এসে আবার বাজির ব্যবসা কী ভাবে করেন? এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘আইনের সমস্ত ফাঁকফোকর জেনে অবৈধ বাজির ব্যবসায় হাত দেন এই ব্যবসায়ীরা।’’ কল্যাণী বিস্ফোরণকাণ্ডে ধৃত খোকনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও তেমনই তথ্য পেয়েছে রানাঘাট জেলা পুলিশ।
কল্যাণী এক্সপ্রেসও লাগোয়া যে সমস্ত এলাকায় বাজি কারখানা চলছে, তার বেশির ভাগই অবৈধ বলে অভিযোগ। বাসিন্দাদের দাবি, ঝুঁকি সত্ত্বেও মূলত দুই কারণে এই ব্যবসা থেকে কেউ সরেন না। এক, ব্যবসায় বড় অঙ্কের লাভ এবং দুই, ধরা পড়লেও কড়া শাস্তি না হওয়ার ‘নিশ্চয়তা’। অনেক ক্ষেত্রের পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। অভিযোগ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রেফতারির পরে বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়। আদালতে পুলিশ জেল হেফাজতের দাবি জানায়। কিন্তু প্রায় সব মামলার ক্ষেত্রে বলা হয়, তেমন বিস্ফোরক উদ্ধার করা যায়নি কিংবা সমস্ত বিস্ফোরক ফেটে গিয়েছে। নয়তো, তৈরি করা বাজিতে আগুন ধরে গিয়েছে বলে নিছক দুর্ঘটনা হিসাবে আদালতে মামলা ওঠে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাজেয়াপ্ত বাজির পরিমাণ বলার মতো কিছু থাকে না। তাই মোটামুটি ১৪ দিন জেলে কাটিয়ে অবৈধ বাজি কারবারিরা আবার বাইরে বেরোন। আবার ব্যবসা শুরু করেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এমনিতে ১৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত বাজি এবং বাজির মশলা তৈরি সরঞ্জাম মজুত করতে হলে জেলাশাসকের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। পরিমাণ ১৫ থেকে ৫০০ কিলোগ্রাম হলে ‘কন্ট্রোলার অফ এক্সপ্লোসিভ’ থেকে লাইসেন্স নেওয়ার নিয়ম। তারও বেশি ওজনের বাজির ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্স দেন ‘চিফ কন্ট্রোলার অফ এক্সপ্লোসিভস’। পাশাপাশি মশলা এবং বাজি তৈরি এবং তা প্যাকেটবন্দি করার কাজেও আলাদা ভাবে অনুমতি নিতে হয়। এই সব কাজের জায়গার মধ্যে দূরত্ব থাকা উচিত মোটামুটি ১৫ মিটারের এবং কারখানা হওয়া উচিত লোকালয় থেকে দূরে।
কল্যাণীর বিভিন্ন বাজি কারখানায় দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করা শ্রমিকদের পরিবার জানাচ্ছেন, অন্য কাজের থেকে একটু বেশি মজুরি পাওয়া যায় এই কাজে। শারীরিক শ্রমও তুলনামূলক ভাবে কম করতে হয়। আর পুলিশের ‘ঝক্কি’ মালিক সামলে নিলে সব মিলিয়ে বাজির ব্যবসা লাভজনক। কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তা? সে ব্যাপারে কোনও দিন খুব একটা মাথা ঘামাননি শ্রমিকেরা। তবে কল্যাণী বিস্ফোরণকাণ্ডে নড়েচড়ে বসেছে রানাঘাট জেলা পুলিশ। জেলা পুলিশ সুপার সানি রাজ বলেন, ‘‘ধৃতকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আইনে যত কঠোর ধারা প্রয়োগের সুযোগ আছে, সবটা করা হবে। অবৈধ বাজি ব্যবসার জন্য কোনও ভাবে কাউকে রেয়াত করা হবে না।’’ এ সবের মধ্যে শনিবারই খোকনকে নিজেদের হেফাজতে নিতে চেয়ে আদালতে হাজির করাচ্ছে পুলিশ।